সরকারের নানা উদ্যোগের পরও দেশে ইন্টারনেট সেবার মানের কোনো উন্নতি নেই। মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। তবে ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে কিছুটা এগিয়ে আছে। ইন্টারনেটের গতি পর্যবেক্ষণে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান স্পিডটেস্টের সর্বশেষ সূচকের তথ্য এ বাস্তবতা জানাচ্ছে। দেশের তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দুটি সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে আমাদের পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইডথ থাকার পরও এ অবস্থা কাম্য নয়। এতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, স্থবির করে দিচ্ছে। সফটওয়্যারশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাও বাধাগ্রস্ত। সর্বোপরি এ বাস্তবতা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের গতিও কমিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট সেবায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণে সাইবার হামলার আশঙ্কাও এড়ানো যাচ্ছে না। সার্বিক এই পরিস্থিতির পেছনে কোনো নাশকতা পরিকল্পনা কাজ করছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট উদ্যোগ ছিল এবং এখনো আছে। আমি মোবাইল ফোন অপারেটরদের একপ্রকার হাতে-পায়ে ধরেছি ফোরজি নেটওয়ার্ক বাড়ানোর জন্য, কিন্তু তারা পাত্তা দেয়নি। প্রয়োজনীয় স্পেকট্রামও (বেতার তরঙ্গ) নিতে চায়নি। এনটিটিএন অপারেটর ও টাওয়ার কম্পানিগুলোও যথাসময়ে কাজ শুরু করেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরতার কারণেই করোনায় হঠাৎ চাহিদা বাড়ার প্রেক্ষাপটে আমরা ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি।’
তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ফাইবার অ্যাট হোম-এর চিফ টেকনোলজি অফিসার সনুম আহমেদ সাবির কালের কণ্ঠকে বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে পাওনা টাকা আদায় নিয়ে নানা জটিলতা এবং ফাইভজি আসছে—এই যুক্তিতে মোবাইল ফোন অপারেটররা দীর্ঘদিন তাদের থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কোনো বিনিয়োগ করেনি। টাওয়ার শেয়ারিং নিয়েও সমস্যা আছে। এসব কারণে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকরা তাদের চাহিদামতো ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় স্পেকট্রাম না থাকার কারণে যে এলাকায় গ্রাহক বেশি সে এলাকায় ইন্টারনেটের গতি কম। যে এলাকায় যতটা বিটিএস প্রয়োজন ততটা নেই। এই পরিস্থিতিতে মানসম্মত সেবা না দিয়েও তারা মুনাফা অর্জন করছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের গত এক বছর এভাবে বিনিয়োগ ছাড়াই লাভের মুখ দেখেছে মোবাইল ফোন অপারেটররা। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও সমস্যা কম নয়। কয়েক হাজার আইএসপি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এই লাইসেন্সধারীদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সনুম আহমেদ সাবির আরো বলেন, ‘বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা নিয়ে একধরনের মাফিয়াচক্র তৈরি হয়ে গেছে। প্রকৃত লাইসেন্সধারীরা সেখানে সেবা দিতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে ইন্টারনেটের মূল্য ৭০ ডলার, সেখানে আমাদের দেশে তা পাঁচ ডলারে পাওয়া যায়। কিন্তু পাঁচ ডলার দিয়ে যে পরিমাণ যে গতির ইন্টারনেট আমরা কিনছি তা আসলেই পাচ্ছি কি না, সেই প্রশ্নের জবাব নেই। ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (আইএসপি) এখনো এনটিটিএন অপারেটরদের ফাইবার অপটিক সেভাবে ব্যবহার করছে না। কিছু ক্ষেত্রে নাশকতাও চলছে। ফাইবার অপটিক কেটে দেওয়া হচ্ছে। কারো নেটওয়ার্কে কৃত্রিমভাবে বেশি ট্রাফিক সৃষ্টি করে গতি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকে তার জায়গার কাজগুলো যদি ঠিকভাবে করে তাহলে এতটা সমস্যা হয় না। ইন্টারনেটের গতি ও সহজলভ্যতার সঙ্গে এখন যেকোনো দেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল অবস্থানে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ প্রচুর পরিমাণে আছে, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তার ব্যবহার অনেক কম। চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সরবরাহ নেই। সরকার বিভিন্ন সময় ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমিয়েছে, কিন্তু উচ্চহারের ট্রান্সমিশন কস্টের কারণে তার সুফল পাওয়া যায়নি। ঢাকার বাইরে ট্রান্সমিশন কস্টের প্রভাব বেশি পড়েছে। ঢাকায় যে ইন্টারনেটের মূল্য এক হাজার টাকা, ঢাকার বাইরে তা আট হাজার টাকায় নিতে হয়। এ কারণে প্রত্যাশা অনুসারে দেশে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ হচ্ছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশে গ্রাহকদের ৯৬ শতাংশই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে, কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা সন্তোষজনক নয়। সফটওয়্যারশিল্পের বিকাশের জন্য দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দরকার। সরকার দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক নিয়ে গেছে। কিন্তু ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকে ইন্টারনেট সার্ভিস অপারেটররা কিভাবে ছড়িয়ে দেবে, সে বিষয়ে নীতিমালা এখনো প্রস্তুত হয়নি। দেশে স্থানীয় এবং বাংলা কনটেন্ট তেমন নেই। ফেসবুক, ইউটিউবেই বেশির ভাগ গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। দেশীয় কনটেন্ট বাড়লে ইন্টারনেটের চাহিদাও বাড়বে।’
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রচুর ব্যান্ডউইডথ পড়ে আছে। দুটি সাবমেরিন কেবল থেকে আমাদের সক্ষমতা ২৮০০ জিবিপিএস। অন্যদিকে দেশে চাহিদা ২৩০০ জিবিপিএসের কাছাকাছি। আমরা এ চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে সক্ষম, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৪৮০ জিবিপিএস। এটা গত ফেব্রুয়ারির হিসাব। দীর্ঘদিন ধরে দেশে চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। বাকি ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ আসছে ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) অপারেটরদের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে।’