করোনা মহামারিতে গত সোয়া এক বছরে বিশ্ব অর্থনীতি ধসিয়ে দিয়েছে। তবে করোনা মহামারির মাঝেও একটি ভালো অর্থবছর পার করেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের ফল এটি। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা ও শ্রমজীবী মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টার ফল। তবে নতুন অর্থবছর শুরু হলো কঠোর লকডাউনের মধ্যদিয়ে।
সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২০-২১) করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা (১৭শ’ কোটি মার্কিন ডলার)। তবে এই সময়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ৮টি সূচক ভালো ছিল। যে কারণে বলা হচ্ছে, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ (প্রাথমিক)। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ০.৮৬ শতাংশ বেশি।
পুঁজিবাজারের চিত্র
করোনা মহামারির আক্রমণের সময়ে গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২০ সময়ে দেশের পুঁজিবাজার ছিল হতাশার ও শঙ্কার। সেই বাজার এখন শুধু ঘুরে দাঁড়াতেই শুরু করেনি, একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে প্রায় এক বছর ধরে। দুর্বলতাগুলোও ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে। পুঁজিবাজার যে শক্ত ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে বিএসইসির গত ১৭ জুন নেওয়া সিদ্ধান্তেই।
বিএসইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে। শেয়ারের দামের ভয়াবহ পতন ঠেকাতে গত বছরের ১৯ মার্চ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়। যাতে বেঁধে দেওয়া ওই সীমার নিচে কোনও শেয়ার নামতে না পারে। এভাবে গত বছরের মার্চে শেয়ার বাজারের ভয়াবহ পতন থামিয়েছিল বিএসইসির তৎকালীন কমিশন। ওই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন এম খায়রুল হোসেন। ফ্লোর প্রাইস আরোপের আগে ১৮ মার্চ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স নেমেছিল ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টে।
এমন বিভৎস অবস্থার মধ্যে বিএসইসির নেতৃত্বেও বদল আসে। খায়রুল হোসেনের বিদায়ের পর বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সেই ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টের সূচক এখন ৬ হাজার ১৫০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এখন সেই বাজারের মুলধন বেড়ে ৫ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংক খাতের চিত্র
অর্থনীতির প্রাণ বলে খ্যাত ব্যাংক খাত করোনার মধ্যেও ভালো ছিল। আর ব্যাংক ভালো থাকা মানেই অর্থনীতি সচল ছিল। অর্থনীতি সচল থাকা মানেই ব্যবসা-বাণিজ্য সচল ছিল। তথ্য বলছে, করোনার পাশাপাশি ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ধাক্কায় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বিপর্যয় নেমেছিল ২০২০ সালের প্রথমার্ধে। কিন্তু বছর শেষে সে বিপর্যয় কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছিল ব্যাংকগুলো। এখন দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংক খাত বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া ডাচ বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এক্সিম, এনসিসি, ঢাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী, যমুনা, এসআইবিএল ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চিত্র
মহামারি করোনার মাঝেও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত মঙ্গলবার (২৯ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৬.০৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ, ২০২০ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার (৩৬.০৩৭ মিলিয়ন ডলার)। এখন সেই রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ এখন রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে। শুধ তাই নয়, রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকেও ঋণ দিচ্ছে সরকার।
প্রবাসী আয়ের খতিয়ান
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসীরা জুন মাসের ২৮ দিনে (২৯ ও ৩০ তারিখের তথ্য এখনও আসেনি) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৭৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। গত বছরের জুন মাসের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। একইভাবে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) ১ জুলাই-২৮ জুন পর্যন্ত ১১ মাস ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৪৫৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬.৪০ শতাংশ বেশি। গত বছর প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৮০৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপের মাঝে গত বছরের জুলাই মাসে মাইলফলক রেমিট্যান্স পায় বাংলাদেশ। ওই মাসে প্রবাসীরা প্রায় ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একক মাসে এত রেমিট্যান্স আগে কখনও আসেনি।
রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি
গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ যা আয় করেছে, তা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, মে মাসে পণ্য রফতানির আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১২ শতাংশ বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশ থেকে মোট তিন হাজার ৫১৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর শুধু মে মাসে রফতানি হয়েছে ৩১০ কেটি ডলারের পণ্য। এপ্রিলের ধারাবাহিকতায় মে মাসেও রফতানি আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা ছিল পোশাক পণ্যের রফতানি। এপ্রিলেও ৩১৩ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তৈরি পোশাক খাত রয়েছে লকডাউনের বাইরে। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও কারখানা সচল রাখা হয়েছে।
রাজস্ব আহরণে অগ্রগতি
দেশের অর্থনীতি সচল থাকায় বড় করদাতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) আয়কর আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এই অর্থবছরে এলটিইউর অধীনে থাকা বড় করদাতারা মোট ২৪ হাজার ১১ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। বিদায়ী অর্থবছরে এলটিইউর কর আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১১ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। এর ফলে ৫ বছর পর আবারও লক্ষ্য অর্জন করলো বড় করদাতাদের এই ইউনিট। ৬ বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করেছে এলটিইউ। তথ্য বলছে, দেশের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা এখানে কর দেন। বর্তমানে তাদের অধীনে ব্যাংক-বিমা, উৎপাদন, গণমাধ্যম, মোবাইল ফোন অপারেটর, ওষুধ খাতসহ মোট ২৮১টি কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানির ৯৮৭ জন পরিচালকও এলটিইউতে বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিয়ে ব্যক্তিগত আয়কর পরিশোধ করেন।
এদিকে ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ করা ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ১১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ সময়ে আহরণ হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যা আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি
অর্থনীতি গতিশীল থাকার কারণে মানুষের মাথা পিছু আয় বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। গতবছর মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার। এই মাথা পিছু আয় বাড়ার কারণে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।