ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণে রাজউক এর পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিধান বাস্তবায়িত হলে আবাসন খাতে ভোগান্তি এবং ব্যয় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) নেতৃবৃন্দ। বিষয়টি আবাসন ব্যবসায়ী এবং যে বা যাহারা ব্যক্তিগত ভবন তৈরি করবেন তাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা হবে অপরিণামদর্শী। শনিবার দুপুরে (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন রিহ্যাব এর প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল)। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রিহ্যাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) কামাল মাহমুদ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফিন্যান্স) প্রকৌলশী মোহাম্মদ সোহেল রানা।
সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাব এর প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিতে আবাসন খাতের বিভিন্ন অবদানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন “গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা জানতে পেরেছি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সভাকক্ষে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত কার্যক্রমের পর্যালোচনা অনুষ্ঠান, যা ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখ রবিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত সভায় প্রস্তাব আকারে সিদ্ধান্ত হয়, অবকাঠামো নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নিতে হবে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন পরিপত্র বা সরকারি আদেশ জারি না হলেও মন্ত্রী মহোদয়কে উক্তি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। উক্ত বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের কারণে গৃহায়ন শিল্প সংশ্লিষ্ট আমাদের মধ্যে গভীর শংকা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।”
আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ভিন্ন ভিন্ন তদারকি সংস্থার অনুমোদন শর্তের পারস্পরিক বৈপরীত্যের শিকার হবেন যারা ভবন নির্মাণ করবেন তারা। দুটো প্রশাসনকে একটি কাজের দায়িত্ব দিলে জনগণের ভোগান্তি শুধুই বাড়বে। ফাইল ছোড়াছুড়ির নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে এবং নতুনভাবে প্ল্যান পাশ করতে সময় বেশি লাগবে। ভবন তৈরিতে সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন, অতিরিক্ত জটিলতা- ভোগান্তি-বিড়ম্বনা এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্যয় সবই বৃদ্ধি করবে। এমনিতেই অস্বাভাবিকভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে। ব্যয় বৃদ্ধির নতুন নতুন খাত নাগরিকদের আবাসনের স্বপ্ন পুরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। মৌলিক অধিকারের স্বপ্ন অপূর্ণ এবং অধরাই থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যে রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট বলেন, বিগত ২০১৯ সনের পূর্বে হাইরাইজ তথা ১০ তলার অধিক বহুতল ভবন নির্মাণে সিটি কর্পোরেশনের ছাড়পত্র গ্রহণ এর একটি বিধান প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিগত ২০১৯ সনে রাজউক কর্তৃক প্ল্যান পাশের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পূর্বে অনুমোদন প্রদানকারি ১০/১১টি প্রতিষ্ঠান/সংস্থার পরিবর্তে ৩টি সংস্থা হতে (রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল এভিয়েশন) অনুমোদন গ্রহণের সহজ প্রক্রিয়া প্রচলন করা হয়। কিন্তু অত্যান্ত উদ্বেগের সাথে পত্রিকা মারফত জানতে পারি শুধুমাত্র বহুতল ভবনই নয় যেকোনো ভবন নির্মাণে সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে একই ভবন নির্মাণ এর ক্ষেত্রে কতবার অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এটা সর্বজনবিদিত যে, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জনগণের ভোগান্তি কমাতে চাচ্ছেন। এ জন্য অনেক কিছু ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রচলন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই রকম একটি ক্ষেত্রে এই জাতীয় সিদ্ধান্ত গৃহায়ন শিল্পের জন্য একটি গভীর ও নবতর সংকট সৃষ্টি করবে। এটিও সর্বজ্ঞাত যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার যেখানে ইজি অব ডুইং বিজনেস করার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছেন সেই অবস্থায়, এই ধরনের সিদ্ধান্ত ইজি অব ডুইং বিজনেস পরিপন্থী বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।
আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, প্রকাশিত সংবাদে আরেকটি অংশ আমাদের আরও শংকিত করেছে সেটি হলো সিটি কর্পোরেশন অনুমোদিত স্থাপনা নিয়মিত মনিটরিং করার ব্যবস্থা রাখবে এবং যদি সিটি কর্পোরেশন মনে করে রাজউক অনুমোদিত অবকাঠামো শহরের জন্য কল্যাণকর নয় তাহলে সেই অবকাঠামোর কাজ বন্ধ করে দিতে পারবে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এই কল্যাণকর বা অকল্যাণকরের মাপকাঠি কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে এই প্রশ্নে আমরা শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। এ সিদ্ধান্তে ভালো কাজ কিছুই হবে না; বরং যারা প্ল্যান জমা দেবেন তাদের হয়রানি বাড়বে। ভবনের প্ল্যান পাস করতে গেলে রাজউকেই মানুষকে হয়রানি পোহাতে হয়। সেখানে নতুন করে অনুমোদনের দায়িত্ব পেলে অবকাঠামো যারা বানাবেন তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হবে সিটি কর্পোরেশনগুলো। সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান কর্মকান্ড দেখলেই বোঝা যায়। এমনিতেই সিটি কর্পোরেশনের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার শেষ নেই। জন্মসনদ জটিলতাসহ সারা বছর মশা, ডেঙ্গু লেগেই থাকে। যদিও বর্তমান মেয়রদ্বয় ব্যক্তি উদ্যোগে নানা ভালো কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন তথাপি সিটি কর্পোরেশনকে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত এই দায়িত্ব দিলে জনবল ও সক্ষমতাহীন এই সিটি কর্পোরেশনেও হয়রানির ক্ষেত্র তৈরি হবে ভয়াবহভাবে।
নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে অনুমোদনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন পেলে তাতে দ্বৈত প্রশাসনের সৃষ্টি হবে। এই সিদ্ধান্ত আসলেই সাংর্ঘষিক ও অবাঞ্চিত। ভোগান্তি কমাতে রিহ্যাব থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে আরো নতুন তদারকি সংস্থা যুক্ত করা হচ্ছে। যা মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মন্তব্য করেন রিহ্যাব এর প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজউক ৫০ বছর এর অধিক সময় থেকে ঢাকায় ছোট-বড় সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে এবং তদারকি সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন রাজউক ও তার জনবল উক্ত কাজে একটি সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা লব্ধ সক্ষমতা অর্জনে সিটি কর্পোরেশন অদ্যবধি নবীনতম বলে স্পষ্টত প্রতিয়মান। সিটি কর্পোরেশন এর তো এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জনবল নেই, কোনো কাঠামো নেই। ফলে ভোগান্তি বেড়ে যাবে আরো কয়েকগুণ।
সিটি কর্পোরেশন থেকে এই ধরনের প্রস্তাব বিনিয়োগবান্ধব নয়। দেশের বিদ্যমান আবাসন সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে আমরা আবাসন খাতের বিনিয়োগকে সহজ করার দাবি জানান রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট। এজন্য সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানান। একই সাথে অর্ধশতকের অভিজ্ঞ রাজউককে শূন্যপদে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে পরিকল্পিত শহর গঠন ও তদারকির দায়িত্ব অব্যাহত রাখার দাবি জানানো হয় রিহ্যাব এর পক্ষ থেকে। লিখিত বক্তব্য শেষে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট।