করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন অতি উচ্চ মাত্রার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও রেখে যেতে পারে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ওমিক্রনের ব্যাপক বিস্তার বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে। এমনকি বিশ্বের অধিকাংশ দেশ অবশেষে করোনা মহামারির প্রায় দুই বছর ধরে বহুল আলোচিত হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিজন কুমার শীল, ডা. বে-নজির আহমেদ ও ডা. এম এইচ চৌধুরী লেনিন বলেন, ওমিক্রন সংক্রমণের মাধ্যমে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভবিষ্যতে করোনার একই ধরনের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে এই হার্ড ইমিউনিটি কতটা টেকসই হবে বা ভবিষ্যতে করোনার অন্য কোনো ধরনের বিরুদ্ধে কতটা ভাল কাজ করবে, তা তারা নিশ্চিত নন।
গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. বিজন কুমার শীল বলেন, ওমিক্রনের ফলে অর্জিত অ্যান্টিবডি করোনার ডেল্টা বা অন্য সব ধরনকে টেক্কা দিতে পারে।
তিনি বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি ওমিক্রনকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। তাই ওমিক্রন খুব শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। তাই বলা যায়, ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে, এই ইমিউনিটি ভবিষ্যতে ভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে।’
তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের প্রায় সব দেশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের কারণে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে যাচ্ছে।
ডা. বিজন বলেন, ওমিক্রনের উদ্ভবের আগে সারা বিশ্বে ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অ্যান্টিবডি ছিল। ‘যেহেতু ওমিক্রন সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, তাই খুব কম মানুষই এই ঢেউয়ের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডির বাইরে থাকবে। সুতরাং, ভবিষ্যতে আসা নতুন ধরনের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই।’
‘আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইতোমধ্যেই ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে এবং বাকিরাও আগামী দিনে এটিতে সংক্রমিত হবে। তাই আমরা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটির দিকে পৌঁছে যাচ্ছি।
তিনি ওমিক্রনকে ছদ্মবেশে আসা আশীর্বাদ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন এই ভ্যারিয়েন্টটি যে হার্ড ইমিউনিটি রেখে যাচ্ছে, তা ভবিষ্যতে করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে সহায়তা করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, যে ভাইরাস যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তা তত দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ‘ওমিক্রনের ক্ষেত্রেও এটি হচ্ছে। কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না ঘটলে এই মাসের মধ্যে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যাবে। এর মানে আমরা এই সময়ের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করব।’
তিনি বলেন, একবার হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হলে যদি ভবিষ্যতে একই রকমের ভ্যারিয়েন্ট আসেও, তবুও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে না। ‘কিন্তু এই অ্যান্টিবডি কতদিন কাজ করবে তা বলা কঠিন। এটাও বলা মুশকিল যে নতুন এমন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসবে না, যা আগের ভ্যারিয়েন্ট বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে অর্জিত অ্যান্টিবডিকে কাবু করে ফেলতে পারে।’
সারা বিশ্বে টিকার বৈষম্য রয়েছে জানিয়ে বিজন কুমার শীল বলেন, ‘অনেক দেশ এখনও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিন দিতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই ওমিক্রন এই বৈষম্য দূর করতে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ব্যাপক সংক্রমণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে তা মূল্যবান। ‘এটি ভবিষ্যতে আসতে পারে এমন যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে একটি খুব শক্তিশালী অ্যান্টিবডি হিসেবে কাজ করবে। এটি টিকার মতো কাজ করবে এবং অসুস্থতার তীব্রতা কমিয়ে আনবে। এটি টিকার মতো সংক্রমণ বন্ধ নাও করতে পারে, তবে এটি অসুস্থতার তীব্রতা কমিয়ে মানুষকে রক্ষা করবে।’
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যদিও ওমিক্রন তুলনামূলকভাবে একটি ক্ষণস্থায়ী ধরন, তবুও এটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি করছে যা টিকার মতো কাজ করে।
তিনি অবশ্য বলেন, করোনার বিরুদ্ধে খুব শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করতে এখনও টিকার প্রয়োজন আছে। ‘যাদের প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডি আছে তাদের যদি ভ্যাকসিন দেয়া হয়, তাহলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যাতে তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবে।’
মহামারি থেকে আঞ্চলিক রোগে রূপান্তর
বিজন কুমার শীল বলেন, ব্যাপক ওমিক্রন সংক্রমণ করোনাকে অঞ্চলিক রোগে পরিণত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন মহামারি থেকে আঞ্চলিক রোগে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এটি একটি মৌসুমি ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হতে পারে। এর অর্থ হল করোনা অদূর ভবিষ্যতে পুরোপুরি চলে যাবে না, তবে ভাইরাসটি বিশ্বের কিছু অংশে ছোট আকারে ছড়াবে।’
ডা. বিজন বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন সংক্রমণ শেষ হয়ে যাবে এবং আগামী বছরের মধ্যে কিছু দেশে করোনাকে আঞ্চলিক রোগ হিসাবে ঘোষণা করতে পারে। যদি না এমন নতুন কোনো অস্বাভাবিক ভ্যারিয়েন্ট আবির্ভাব হয়, যা বিদ্যমান অ্যান্টিবডিগুলিকে অকার্যকর করে ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, শিশুসহ বেশিরভাগ মানুষ ওমিক্রন দ্বারা সংক্রামিত হচ্ছে। ‘কিন্তু যারা এক বা দুই মাস পরে জন্ম নেবে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি থাকবে না, কারণ ততদিনে ভাইরাস সংক্রমণ কমে যাবে। যদি এই শিশুদের টিকা না দেয়া হয় তবে তারা ভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকবে।
ডা. বে-নজির বলেন, ‘আমরা বলতে পারি যদি কোনো ভিন্ন রূপ না আসে এবং ওমিক্রনের মাধ্যমে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি ভালোভাবে কাজ করে তাহলে করোনা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে একটি মৌসুমী ভাইরাসে পরিণত হবে।’
তিনি আরও বলেন, করোনা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমিত হতে থাকবে। ‘সুতরাং, আমরা বলতে পারি ওমিক্রন করোনা মহামারির শেষের দিকে শুরু হয়েছে, তবে আমরা এখনও এটি সম্পর্কে সতর্ক রয়েছি।’
ওমিক্রন শেষ ধরন নাও হতে পারে
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. লেনিন বলেছেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন না। ‘বরং তারা টিকা দেয়ার মাধ্যমে ইমিউনিটি অর্জনের কথা বলছেন।’
আরও পড়ুন : করোনায় আরও ২৮ মৃত্যু, শনাক্তের হার ১৪.৮৫ শতাংশ
তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন শেষ ভ্যারিয়েন্ট নাও হতে পারে। কারণ নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসবে। আমরা দেখেছি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দ্বারা অর্জিত অ্যান্টিবডি ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি। সুতরাং, আমরা এখন বলতে পারি না যে ওমিক্রন সংক্রমণের মাধ্যমে অর্জিত ইমিউনিটি আমাদের করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা করবে।’
ডা. লেনিন বলেন, প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর না করে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন এবং করোনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা গড়ে তোলার জন্য সরকারের উচিত জনসংখ্যার অন্তত ৮০ শতাংশকে গণটিকাদানের আওতায় আনা।