ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম হওয়ায় (২ থেকে ৪ শতাংশ বা কোনো কোনো ব্যাংকে তার চেয়েও কম) নিশ্চিত মূলধন ফেরত ও বেশি মুনাফার আশায় ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ হিসাবে সঞ্চয়পত্র কিনছেন সাধারণ মানুষ। কারণ ব্যাংকের চেয়ে প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে সঞ্চয়পত্র থেকে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের হালনাগাদ পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭০ হাজার ২২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসাবে গেল অর্থবছরের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ আসে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ কম দিচ্ছে। যার কারণে বেশি মুনাফার আশায় বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করেও সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল, তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
গত অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ দিকে এ খাতের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এর লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু আলোচিত অর্থবছরে নিট ঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি ঋণ আসে সঞ্চয়পত্রে।
অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ৪ হাজার ৫৭৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা নিট ঋণ আসে। ২০২০ সালের জুন মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ আসে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয় সরকার। ঋণের সুদহার কমাতে থাকে, কিন্তু যে হারে ঋণের সুদ কমায় তার চেয়ে বেশি হারে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনে। ফলে এখন আমানতের সুদহার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জুলাই’২১ এর তথ্য বলছে, বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতের বিপরীতে এখন ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১ থেকে ২ শতাংশও দিচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে সুদ মিলছে ১০ থেকে ১১ শতাংশের ওপরে।
এদিকে গত জুন মাসে ব্যাংক খাতের আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪.১৩ শতাংশ; যা মূল্যস্ফীতি হারের চেয়েও কম। এ কারণে গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক নির্দেশনায় তিন মাসের থেকে বেশি সময়ের জন্য রক্ষিত আমানতের সুদহার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি হারের কম হবে না বলে জানায়। যেখানে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১০ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। এ কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উল্লম্ফন হওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণও বাড়ছে।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের ঋণ বাড়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম ঋণ নিতে হয়েছে সরকারকে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার নিট ঋণ করে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্য ছিল ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্র থেকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ঋণ আসায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা করা হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। ওই সুদহারই এখন পর্যন্ত বহাল আছে।
বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.০৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.৫২ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মের পর থেকে এই হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।