চাল দেশের বাজার থেকে কিনে প্যাকেটজাত করে তা আবার বিক্রি করা যাবে না। এজন্য একটি সার্কুলার জারির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
বুধবার (১ জুন) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এ কথা জানান।
বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধভাবে মজুত ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন টিম ও প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বেশ কিছু বাজারে চালের আড়তে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘ছয়টি প্রতিষ্ঠান ব্যাগিং করে একই চাল যেটা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পড়ছে, সেটা প্যাকেটজাত করে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে। একই সঙ্গে আগাম টাকা মিলারদের দিয়ে আসছে, এমনকি প্যাকেটও দিয়ে আসছে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া ইত্যাদি স্থানে। আমরা সেগুলোও বন্ধ করেছি।’
মোটা চাল ও ধানের দাম কিন্তু খুব একটা বাড়েনি দাবি করে সাধন চন্দ্র বলেন, ‘যেটা আটাশ, ঊনত্রিশ, শম্পাকাটারি, জিরাকাটারি যেটাকে নাজিরশাইল বা মিনিকেট বলে বিক্রি করে এটার দাম বেড়েছে। একটি বিষয় কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই যে বিপুল পরিমাণ চাল যখন এরা (কোম্পানি) তুলে নিচ্ছে, প্যাকেট করতে লাগে তিন টাকা, বিক্রি করছে ১০ টাকা ১৫ টাকা বেশি দামে। এর জন্য তার বেশি দামে কিনে আনতেও সমস্যা নেই। এ কারণে যারা এদের কাছে চাল বিক্রি করছে তারা বাজারে ধানটাও প্রতিযোগিতা করে কিনছে। এরপরও কৃষক বলে তাদের লস হচ্ছে।’
ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘সেটা আমরা চিন্তা করছি যে, এই সার্কুলার জারি করা যায় কিনা যারা প্যাকেট করে চাল বিক্রি করবে তারা দেশের বাজার থেকে কিনতে পারবে না। তারা ৬৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আমদানি করে প্যাকেট করবে। এটা আলোচনা চলছে। কালও আমাদের মিটিং হয়েছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের সচিব নেই। তিনি ৮ জুন কাজে যোগ দেবেন। আমরা এটার সামারি রেডি করছি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানোর জন্য। কৃষি সচিব, খাদ্য সচিব, বাণিজ্য সচিব ও শিল্প সচিব- এই চারজন মিলে একটি মিটিং করবে ভোক্তা অধিকারকে নিয়ে, উপায় বের করার জন্য।’
‘এটা এখনও ফাইনাল হয়নি। তাদের যদি নিজস্ব মিল থাকে তারা সেখানে প্যাকেট করতে পারবে। কিন্তু বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করে প্যাকেট করতে দেবো না। আমাদের মেসেজটা, যেখানে তারা প্যাকেট করে সেখানে দেওয়া হয়েছে। এরা ছাড়া তো কেউ প্যাকেট করে না। খুচরা কিনে তারা প্যাকেট করতে পারবে না। মিল মালিকরা নিজস্ব প্রডাকশন বিক্রি করতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিজস্ব মিল থাকলেও সে তার লাইসেন্সে যে মজুতের বিধান আছে এর বাইরে মজুত করতে পারবে না। মিলের যে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতা এর তিনগুণ সে মজুত করতে পারবে। এর বাইরে থাকলে সেটা অবৈধ মজুত।’
বিভিন্ন জেলায় অভিযান চলছে। দিনাজপুরে দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপের মিল আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘সেই মিলের যে পাক্ষিক ক্ষমতা দেওয়া আছে সর্বোচ্চ এর তিনগুণ তারা মজুত করতে পারবে। একটি বাজারে যাবে, একটি উৎপাদনে যাবে, আরেকটি মজুত থাকবে। সেটার পরও প্রায় পাঁচ হাজার টন প্রায় উদ্বৃত্ত ছিল। এটাকে সিলগালা করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মোকাদ্দমা করা হয়েছে। তাদের মালামাল জব্দ করা হয়েছে।’
মহাদেবপুরে আরেকটি গ্রুপ দুটো মিল ভাড়া নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাড়া যদি তারা নিয়ে থাকে তাহলে ভাড়ার যে মিলটি আছে সে মিলের ব্র্যান্ডেই কিন্তু চাল বস্তায় ভরতে হবে।’ সেখানে গিয়ে ওই গ্রুপের বস্তা পাওয়া গেছে, তা জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক চালের বাজারে, আড়তে এবং মিলে এমনটি গ্রামাঞ্চলেও কৃষক ছাড়া কেউ যদি ধান কিনে মজুত রাখে সেখানেও অভিযান চালানো হচ্ছে। এটা ধারাবাহিকভাবে চলবে।’
‘পাশাপাশি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, মিল মালিক এবং চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করছি। সেখানেও বলা হচ্ছে এবং মন্ত্রণালয় থেকে আমরা চিঠিও দিয়েছি। সেই হিসেবে কাজ চলছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন বৃষ্টিতে ও বন্যায় ক্ষতি হয়েছে, আসলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, এটা বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে কৃষি অফিসার, খাদ্য কর্মকর্তা এবং ডিসিসহ এটার প্রকৃত চিত্র নির্ণয় করে কৃষি মন্ত্রণালয় ও আমাদের পাঠানোর জন্য।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসবো আদৌও যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে তা হয়েছে নাকি এর চেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে। আমাদের চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকলে তো আমরা এটা বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতে পারবো না। আশা করি সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট পাবো এবং আমাদের অভিযানও ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।’
বড় বড় মিল মালিকদের দিকেও নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘যারা একেবারেই ধান ব্যবসায়ী নয়, তারাও মজুত করছে, ইটের ভাটাওয়ালাও মজুত করছে। এটাও আমরা খুঁজে পেয়েছি। এমনকি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও চাল কিনে মজুত করছেন।’
‘আরেকটি বিষয় হলো- মানুষ মনে হয় হতাশায় ভুগছে যে কী হয় কী হয় এর জন্য মাসের চাল এক মাসের না কিনে তিন মাসেরটা একসঙ্গে কিনছে, এটাও কিন্তু (দাম বাড়ার) কারণ। আমি ভোক্তাদের বলতে চাই একসঙ্গে চার থেকে পাঁচ মাসের চাল কিনে বাজার অস্থিতিশীল করবেন না।’
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটাও বলেছি এই মজুতদারদের মধ্যে দল-নির্দল কোনো কিছুই দেখার বিষয় নেই। কারণ মজুতদাররাই একটি ভিন্ন দল। আমি তো নির্দেশ দিয়েছি ১৯৭৪ এর স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে মামলা করতে। সেখানে আমাদের ডিসি সাহেবরা একটু ভয় পান। আমি বলেছি এই অ্যাক্টেই মামলা করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য নিয়ে যদি দেখি, তাহলে আমদানি করবো। যদি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে দেখি এদের উচিত শিক্ষা দিতে ট্যাক্স কমিয়ে বর্ডার খুলতে হয়, তাই করবো। তাহলে শিক্ষা পাবে।’
সিন্ডিকেট সরকারের চেয়ে ক্ষমতাবান নয় জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্যই আমরা গতকাল থেকে অভিযান শুরু করেছি। এটাও ঠিক নির্বাচনের আগমুহূর্তে কেউ কেউ তো আছেন যে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। আমরা সচেতন আছি। আমরা অভিযান শুরু করেছি দেখা যাক। আশা করি এদের কন্ট্রোল করতে পারবো।’
সরকার করপোরেট ফাঁদে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না কোনো ফাঁদে পড়েনি। ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছিল আমরা রিকভার করছি।’