মঙ্গলবার, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

UCB Bank

নাজুক অবস্থায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলো

প্রকাশঃ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চলছে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বেড়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কর্তৃত্বও নেই এসব ব্যাংকে। ফলে বাড়ছে নানা জাল-জালিয়াতি, অর্থপাচার ও আত্মসাতের ঘটনা। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাগামহীন ভাবে। নানা সংকটে মূলধনও খেয়ে ফেলছে। এতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।

ক্রিসেন্ট গ্রুপের নানা জাল-জালিয়াতি, অর্থপাচার ও আত্মসাতের ঘটনার পর ডুবছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। হল-মার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির বোঝা বইছে সোনালী ব্যাংক। ঋণ জালিয়াতিতে এখনও বেহাল দসা বেসিকের। অগ্রণী, রূপালী ও বিডিবিএলেরও একই অবস্থা।

এসব ব্যাংককে খারাপ অবস্থা থেকে ফেরাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করে সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি ঋণ কেলেঙ্কারির নেপথ্যের নায়কদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। খেলাপি ঋণ বেড়েছে। প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ, মূলধন ঘাটতি ও লোকসানের কারণে নাজুক অবস্থায় পড়েছে এসব ব্যাংক।

জনতা ব্যাংক: ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে কোণঠাসা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের ভারে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এখন সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৪১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৩.৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ওই দুটি গ্রুপের ঋণই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে চার হাজার ৮৮৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। এর ফলে ব্যাংকটি বড় লোকসানে পড়বে।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, এর মূল কারণ ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ। ওই দুটি গ্রুপের ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণ অনেকে বেড়েছে। এজন্য মামলা ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ১২০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে। আশা করছি, চলতি বছরে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

সোনালী ব্যাংক: হল-মার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির বোঝা এখনও বাইছে সোনালী ব্যাংক। হল-মার্কের কাছে সোনালী ব্যাংকেরই আটকে আছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকটির আর্থিক সূচকেরও উন্নতি নেই। ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯.২৬ শতাংশ। ফলে প্রতিষ্ঠানটির মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৩৪০ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

বেসিক ব্যাংক: ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুট হয়। টাকার অঙ্কে দেশের ইতিহাসে এককভাবে এটাই সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি। ব্যাংকটির এ লুণ্ঠনে সরাসরি জড়িত ছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু। তাকে সহায়তা করেন ওই সময়ের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি।

২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৮০৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৫৮.২৪ শতাংশ। খেলাপির চাপে ব্যাংকটি মূলধনও খেয়ে ফেলছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২৩৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক: আলোচিত মুন গ্রুপ কেলেঙ্কারিসহ ঋণ বিতরণে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে অগ্রণী ব্যাংক। ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৪৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭.১০ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

রূপালী ব্যাংক: নানা অনিয়মের কারণে বিতরণ করা ঋণ ফেরত আনতে পারছে না রূপালী ব্যাংক। ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৮০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮.১৬ শতাংশ। আলোচিত সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৪৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

বিডিবিএল: অযোগ্য ব্যক্তি এবং ভুঁইফোড় কিছু প্রতিষ্ঠানকে জামানতবিহীন ঋণ দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল)। আদায় হচ্ছে না বেনামে যাওয়া ঋণ। ফলে বাড়ছে খেলাপি। সর্বশেষ তথ্য  জানা যায় প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের ৫৬.২৭ শতাংশই খেলাপি। ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিক ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৯০০ কোটি টাকা। আর মন্দ ঋণের কারণে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশন রাখতে হয়েছে ৩৯১ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নাজুক পরিস্থিতির মূল কারণ হলো, সুশাসনের অভাব। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো রয়েছে-ই।

তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। বিভিন্ন চাপের কারণে ব্যাংকগুলোরও কিছুই করার থাকে না। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলো মূলধনও খেয়ে ফেলছে। খেলাপি ঋণ না কমলে ব্যাংক খাত স্বাভাবিক হবে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে বলে, বলেন সাবেক এ গভর্নর।

শেয়ার করুনঃ

উপরের পোস্টটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এই মাত্র প্রকাশিত

এই বিভাগের আরও সংবাদ