শিল্পঋণের ব্যাংক সুদ যখন ১৩-১৪ শতাংশ, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক সব ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। আর মেয়াদি আমানতের সুদ যখন ১ শতাংশ পর্যন্ত নেমে যায়, তখন আমানতের সর্বনিম্ন সুদ ঠিক মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশিত সুদকে ‘হুকুমের সুদ’ হিসেবে বলেছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ব্যাংকগুলো এটা মানতে বাধ্য। আর এতে চাপে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ থেকে মুনাফার লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়। তাই নির্দেশিত সুদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর ঋণ ও আমানত—দুটোরই সুদ নির্ধারণ করে দেওয়ায় বাজারভিত্তিক সুদের প্রথা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে তিন মাস এবং তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। আমানতের সুদহার বাড়ানোর কারণে যেসব ঋণের সুদ ৯ শতাংশের নিচে ছিল, তা–ও বাড়াতে শুরু করেছে।
কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন মেয়াদি আমানত গ্রহণে শাখাগুলো তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। মেয়াদি আমানতের বদলে সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যার সুদ এখনো ৪ শতাংশের নিচে।
আরও পড়ুন : মো. শফিকুল ইসলাম হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক
এমন পরিস্থিতির বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ও. রশীদ বলেন, ‘আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়ার বড় প্রভাব পড়তে পারে মুনাফায়। ভালো মুনাফা না করতে পারলে ব্যাংক মূলধন বাড়াতে পারবে না। মূলধন না বাড়লে প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবন, মানবসম্পদ ও ব্যাংকের সেবা সম্প্রসারিত হবে না। এটা একটা চক্রের মতো, একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। এ ছাড়া আমানতের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন উচ্চ সুদের আমানতের জন্য কোনো চেষ্টা করছে না।’
এর আগে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। ঋণ আদায়ে ছাড় দেওয়া হয়। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণেও মন্দাবস্থা দেখা দেয়। তবে বিভিন্ন খরচ এবং বিদেশে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় বাড়াতে থাকে। তাতে ব্যাংকে তারল্য বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। ঋণের সুদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় গত বছর ব্যাংকগুলোর সুদ আয় কমে যায়। আবার আমানত বাড়লেও সুদ ব্যয় কমে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা কমে হয় ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে নিট মুনাফা ছিল ৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা ও ২০১৭ সালে ৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আমানতের সুদ বাড়ানোর কারণে নতুন মেয়াদি আমানত নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ সুদের যেসব আমানত রয়েছে, তা–ও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ঋণের সুদহারও ধীরে ধীরে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে চেনাজানা গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে।
ব্যাংকগুলোকে এই চাপ সামলাতে পরিচালনা ও বাহুল্য খরচ কমাতে হতে পারে। এমনকি প্রযুক্তির সহায়তায় কম খরচের সেবার দিকে ঝুঁকবে। মুনাফার লক্ষ্য নির্ধারিত থাকায় অনেক ব্যাংককে চাপে থাকতে হবে। এটাই এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি হয়ে গেছে।’