বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর মুদ্রা ডলারের দাপটে বেসামাল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। বেড়েই চলেছে দাম; কমছে টাকার মান। ডলারের এই সংকটে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে পণ্যের দাম। বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির পারদকে আরও উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
অনেকেই ভাবতে পারেন ডলারের দাপট শুধু বাংলাদেশে; কিন্তু তথ্য বলছে, ঠিক উল্টোটা। বাংলাদেশে আমেরিকান ডলার যতোটা শক্তিশালী হয়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী হয়েছে পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ অন্য সব দেশে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বড় অর্থনীতির ১২টি দেশের গত এক বছরের মুদ্রা বিনিময় হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দাম সবচেয়ে কম বেড়েছে; ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির বিপরীতে; ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ভারতের মুদ্রা রুপির বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বৃহস্পতিবার টাকা ডলারের বিনময় হার ছিল ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ ১ ডলারের জন্য ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এক বছর আগে গত বছরের ১৮ মে এই বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৬৫ পয়সা।
এ হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশে সম সময়ই আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার বা ব্যাংক রেটের চেয়ে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজেরেও বেশি ছিল ডলারের দাম। সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবধান আরও বেড়েছে।
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বৃহস্পতিবার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি হলেও ব্যাংকগুলো তার চেয়ে ৭/৮ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে।
ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক বৃহস্পতিবার ৯২ টাকা ৪৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক করেছে ৯৪ টাকায়। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আর বেসরকারি ইস্টার্ন ও প্রইম ব্যাংক ৯৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
খোলাবাজারে ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও বৃহস্পতিবার অবশ্য ৯৬ টাকায় নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এর পর থেকেই শক্তিশালী হতে থাকে ডলার; দুর্বল হচ্ছে টাকা।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ৯ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর বেড়েছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সরকারও ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন করেছে। সবশেষ বৃহস্পতিবারও রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া বড় দরপতন করেছে রুপির।
এখন ডলার ভারতীয় রুপির বিনিময় হার হচ্ছে প্রায় ৭৮ রুপি। এক বছর আগে ২০২১ সালের ১৯মে ছিল ৭৩ রুপির কিছু বেশি। এ হিসাবেই ডলারের বিপরীতে রুপির মান কমেছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ।
ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির। ১ ডলারের জন্য পাকিস্তানে এখন হাতে গুণে ২০১ খরচ করতে হয়। এক বছর আগে ২০২১ সালের ১৯ মে লাগতো ১৬৫ টাকা।
এ হিসাবে এই এক বছরে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির মান কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ।
অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, টাকার মান এখন পাকিস্তানি রুপির দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ডলারের জন্য এখন ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা গুনতে হচ্ছে। আর এক ডলারের জন্য পাকিস্তানে খরচ করতে হচ্ছে ২০১ পাকিস্তানি রুপি।
অন্যান্য মুদ্রার মধ্যে এই এক বছরে জলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন বা অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ব্রিটিশ পাউন্ড দর হারিয়েছে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ।
জাপানি ইয়েনের দরপতন হয়েছে ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চিনের মদ্রা চায়না ইয়ান মান হারিয়েছে ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। নেপালি রুপির দরপতন হয়েছে ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এ ছাড়া এক বছরে ডলারের বিপরীতে অষ্ট্রেলিয়ান ডলারের অবমূল্যায় হয়েছে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশএবং সাউথ আফ্রিকার মুদ্রা রেন্ডের দরপতন হয়েছে১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এদিকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাড়ে ১০ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯মে পর্যন্ত) ৫৫০কোটি (৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে ডলারের দর।
খোলা বাজারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো হাত নেই। তবে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে থাকে। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ডলার কিনে সেই ডলার বিক্রি করে থাকে ব্যাংকগুলো।
এর আগে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর বিক্রি করা ডলারের দর আর আন্তব্যাংক রেটের মধ্যে বেশি ব্যবধান হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পার্থক্যের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিত; সেটা এক থেকে দুই টাকার মধ্যে থাকত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক রেটের চেয়ে অনেক বেশি দামে ডলার বিক্রি করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চারটি তদন্ত দল মাঠে নেমেছে। তারা ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করতে শুরু করেছে।