বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
লবণে উচ্চমাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিককণা শনাক্ত করেছেন।
চলতি বছরের জুনে আমস্টারডামভিত্তিক রিজিওনাল স্টাডিজ অন মেরিন সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১২ কেজি কাঁচা লবণে ৯ হাজার ৬৪০টি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। সমুদ্রবেষ্টিত এলাকা থেকে সংগৃহীত লবণে বেশি পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।
নোবিপ্রবির সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন।
আগের গবেষণার চেয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। এর আগে ২০২১ সালে পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় প্রতি কেজি কাঁচা লবণে ৭৮ থেকে ১৩৭টি কণা খুঁজে পেয়েছিলেন গবেষকরা।
২০২১ সালের গবেষণাটি বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) ও নোবিপ্রবির ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগ যৌথভাবে করেছিল। ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকস পলিউশন ইন সল্ট প্যানস ফ্রম মহেশখালী চ্যানেল, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০২১ সালের নভেম্বরে নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়।
সোডিয়াম ক্লোরাইডের সমন্বয়ে গঠিত লবণ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে উত্পাদিত হয়। এটি আমাদের খাদ্যের একটি অপরিহার্য অংশ, যা মানবদেহের জন্য অনিবার্য খনিজ যোগায়।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
গবেষকরা জানান, সাবান, ফেসওয়াশ, ক্লিনজার এবং বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজিং ও একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মতো টয়লেট্রিজ পণ্যের কারণে কাঁচা লবণের দূষণ ঘটে।
বিওআরআইয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ২০২১ সালের গবেষণাটি পরিচালনা করা গবেষক দলের সদস্য সুলতান আল নাহিয়ান বলেন, সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছে।
‘যেহেতু সাম্প্রতিক গবেষণায় আমাদের গবেষণার তুলনায় লবণে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার তথ্য জানা গেছে, তাই আমি এটি উদ্বেগজনক বলে মনে করি। অর্থাৎ আমাদের সমুদ্র এখন প্লাস্টিক বর্জ্যের সংস্পর্শে এসে আরও দূষিত। মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ রোধে আমাদের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া উচিত’, বলেন তিনি।
২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলবর্তী দ্বীপ কুতুবদিয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ কুতুবদিয়ার প্যানে প্রতি কেজি লবণে ১ হাজার ২৫৩টি এবং উত্তর কুতুবদিয়ায় ১ হাজার ২৬টি কণা ছিল।
২৪ শতাংশ কণা কালো, ১৭ শতাংশ স্বচ্ছ ও ১৫ শতাংশ হলুদ। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কালো রঙের কণা বেশি থাকার কারণ সম্ভবত জেলেদের ব্যবহৃত কালো সুতা ও দড়ি এবং কালো প্লাস্টিক, যা কৃষকরা লবণ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করে।
গবেষকরা দেখেছেন, প্লাস্টিককণার আকার শূন্য দশমিক তিন থেকে এক দশমিক পাঁচ মাইক্রোমিটার, যার বেশিরভাগই ফাইবার ও ফেনা।
গবেষণার নমুনা সংগ্রহের জন্য যে ১২টি স্থান বেছে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হলো—কক্সবাজারের নাপিতখালী, মহেশখালী, বদরখালী, ছনুয়া, ইলিশিয়া, দরবেশখাতা, দক্ষিণ কুতুবদিয়া, উত্তর কুতুবদিয়া, রাজাখালী, পুঁইছড়ি ও গুড়াখালী এবং চট্টগ্রামের ডুলাহাজারা।
সমুদ্রের পানির দূষণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে লবণের প্যানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবর্তিত হয়।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি কেজি লবণে গড়ে ৮০৩টি, শ্রীলঙ্কায় ১ হাজার ৬৯০টি, চীনে ১ হাজার ৫০০টি, কোরিয়ায় ১ হাজার ২০০টি, ভিয়েতনামে ৯০০টি ও থাইল্যান্ডে ৭০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির যৌথ সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গড় পরিমাণ ৩৫ থেকে ৫৭৫।
নোবিপ্রবির সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মমিন সিদ্দিক জানান, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রের পানি অত্যন্ত দূষিত, যেখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক।
তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় পানি প্লাস্টিককণায় দূষিত হয়েছে এবং যেসব স্থান উপকূলে অবস্থিত, সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্বও বেশি।
‘সমুদ্রের পানি লবণের প্যানে প্রবাহিত হয় ডাইকের মাধ্যমে। তাই ডাইকের মুখে সমুদ্রের পানি ফিল্টার করার মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি কমানো যেতে পারে’, বলেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় বাণিজ্যিক লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। তারা ১০টি ভিন্ন ব্র্যান্ডের লবণের বেশ কয়েকটি প্যাকেট ও কাঁচা লবণের তিন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যে নমুনাগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাতে প্রতি কেজি লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ ৩৭০ থেকে ৭ হাজার ৪০০। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর একজন ব্যক্তির মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৮৮।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন জানান, তাদের সংগৃহীত নমুনায় বিভিন্ন আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তার মধ্যে বাণিজ্যিক লবণে এর পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে, যার আকার শূন্য দশমিক পাঁচ মিলিমিটারের কম এবং তা স্বচ্ছ রঙের।
‘এজন্য বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন লবণ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণ করা কঠিন হতে পারে’, বলেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, ধীরে ধীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করলে মানবদেহে একাধিক পর্যায়ে ক্ষতি হতে পারে।
‘প্রাথমিকভাবে এটি মানবদেহের হজম এনজাইমকে বাধা দেয়, যা পেটে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে এটি লিভার ও কিডনিকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতেও বাধা দেবে। নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। কারণ এটি আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি’, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক (সল্ট সেল) সারওয়ার হোসেন জানান, সমুদ্রের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ রোধে করণীয় নির্ধারণের জন্য তারা গবেষণা দলকে বেশ কয়েকটি চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উত্তর পাননি।
‘আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করব। কারণ এটি জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে’, বলেন তিনি।