পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ। এখন কেবল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। সরকারের ঘোষণা অনুসারে ২৫ জুন উদ্বোধনের পরদিন ভোর থেকে এই সেতু সর্বসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
পদ্মা সেতু নিয়ে সর্বসাধারণের আগ্রহের শেষ নেই। বিশেষ করে সেতুর খুঁটিনাটি এবং খরচের বিভিন্ন খাত সম্পর্কে জানার আগ্রহ দেখা যায় মানুষের।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, পদ্মা সেতু ও এ সংশ্লিষ্ট সব অবকাঠামো নির্মাণে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় এই অংকের হলেও মূল সেতু নির্মাণে এর তিন ভাগের এক ভাগ খরচ হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, পুনর্বাসন প্রকল্পসহ অন্যান্য খাতে।
সেতু নির্মাণে খরচ
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ পদ্মা নদীতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, স্থলভাগে অর্থাৎ মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে পড়েছে ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার। প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
সেতুর পাশ দিয়ে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন আছে, সেখানে খরচ এক হাজার কোটি টাকা। মূল সেতুর রেললাইনের পাশ দিয়ে গ্যাস লাইন টানা হয়েছে। এই গ্যাস লাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে আরও ৩০০ কোটি টাকা।
নদীশাসনে খরচ
পদ্মা সেতু এলাকাকে নদী ভাঙনসহ যে কোনো দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা এলাকায় ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার নদীশাসন হচ্ছে। এই কাজ করছে চীনের কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। খরচ হচ্ছে আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
সংযোগ সড়ক
পদ্মা সেতুকে দুই অংশের মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নির্মিত হয়েছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের অ্যাপ্রোচ রোড বা সংযোগ সড়ক। জাজিরা প্রান্তের মূল অ্যাপ্রোচ সড়কটি ১০ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। এর সঙ্গে আশেপাশের স্থানীয় সড়কগুলোকে সংযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও ১২ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়কের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও ৩ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক। এই সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।
সার্ভিস এরিয়ায় নানা খাতে ব্যয়
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে সার্ভিস এরিয়া-২ এর জন্য ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট অ্যান্ড সেফটি টিমের জন্য প্রথম পর্যায়ে ৭২ কোটি ১৩ রাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট অ্যান্ড সেফটি টিমের নিরাপত্তা কাজের জন্য আরও কিছু ব্যয় হয়েছে। জলযান ক্রয় চুক্তি মূল্য ৭৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট-১ বাবদ চুড়ান্ত কিস্তি পর্যন্ত ব্যয় ৮৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কাজের বাস্তব কাজের অগ্রগতি শতভাগ। কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট-২ বাবদ চুক্তিমূল্য ৬০৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
ভূমি অধিগ্রহণ
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণেও খরচ হয়েছে মোটা অংকের টাকা। সেখানে মোট ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে দুই হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর জমি। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের দিতে হয়েছে দুই হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
পুনর্বাসন
পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে ওই এলাকায় বসবাসরতদের অনেককে বাড়িঘর ত্যাগ করতে হয়েছে। এই ত্যাগী মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। তাদের জন্য পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্মলিত সাতটি পুনর্বাসন সাইট নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্লট নিতে তিন জেলার ২২ হাজার ৫৯৩ উপকারভোগীর মাঝে এ পর্যন্ত ৭৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জের ছয় হাজার ৬৭৬ উপকারভোগীর মাঝে ৩২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, মাদারীপুরের ৯ হাজার ৬৭০ উপকারভোগীর মাঝে ২৭১ কোটি ২০ লাখ এবং শরীয়তপুরের ৬ হাজার ২৪৭ জন উপকারভোগীর মাঝে ১৫৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ভিটা উন্নয়নের জন্য তিন জেলায় এক হাজার ১৪১ জনকে ২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
গ্রামীণ সড়ক
পদ্মা সেতুর কল্যাণে আশপাশের এলাকার রূপও বদলে যাচ্ছে। সেখানে এলজিইডির মাধ্যমে নির্মিত হচ্ছে বা সংস্কার হচ্ছে গ্রামীণ সড়কও। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ছয়টি গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ বাবদ মোট ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার চারটি গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নেও ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
বৃক্ষরোপণে ব্যয়
পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে পুনর্বাসন এলাকা, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়াগুলোতে বনায়নের জন্য এ পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ৭৩ হাজার ২৯৪ টি গাছ লাগানো হয়েছে, এর মধ্যে বন বিভাগ ঢাকা ও ফরিদপুরের মাধ্যমে এক লাখ ৪৮ হাজার ৭০০টি এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড ও অন্যান্য ঠিকাদারের মাধ্যমে ২৪ হাজার ৫৯৪টি গাছ লাগানো হয়েছে। নদী শাসন ও মূল সেতুর কাজ সম্পন্নপুর্বক জায়গা অবমুক্ত হলে আরও বৃক্ষ রোপণ করা সম্ভব হবে। এখাতে মোট ব্যয় প্রায় ৯ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপন
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মধ্যে চুক্তির আওতায় ‘পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা’ করা হচ্ছে। এর জন্য নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ চলমান আছে। মে ২০২২ পর্যন্ত সর্বমোট ২ হাজার ৩৫৫ টি নমুনা সংগ্রহপূর্বক সংরক্ষণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু জাদুঘরের জন্য প্রস্তাবিত ভবন নির্মাণ কাজ বিলম্ব হওয়ায় জাদুঘরের কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হচ্ছে। এখাতে ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৩ টাকা ব্যয় হয়েছে।
পরিবেশ খাতে ব্যয়
জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি খাতেও সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা সম্পন্ন হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণার কার্যক্রম চলমান আছে। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ‘খসড়া ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ পরামর্শক দল কর্তৃক দাখিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্যানেল অব এক্সপার্ট এর সদস্যগণ হতে প্রাপ্ত মতামতসমূহ সমন্বয়পূর্বক ‘খসড়া ম্যানেজমেন্ট প্লান’ চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান আছে। এখাতে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
এছাড়া পরিবেশগত সকল কার্যক্রমে এ পর্যন্ত সর্বমোট ব্যয় ২৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালটেন্সি খাতেও ব্যয় ১২৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
মসজিদ, বিদ্যালয়, কবরস্থানসহ বিভিন্ন খাত
পদ্মা সেতু প্রকল্পের চারটি পুনর্বাসন এলাকায় স্থাপিত হয়েছে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পুনর্বাসন এলাকায় আছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রও। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ১৩টি নতুন মসজিদ নির্মাণ, তিনটি কবরস্থান নির্মাণ ও তিনটি মসজিদও সংস্কার করা হয়েছে। এসব খাতেও নানা অংকে খরচ হয়েছে।
যশোলদিয়া এলাকার জলবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আউট-লেট ড্রেন নির্মাণ বাবদ এক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কুমারভোগ এলাকার জলবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আউট-লেটড্রেন নির্মাণ বাবদ সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ৪৮টি হস্তচালিত টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের পুনর্বাসন খাত হতে প্রকল্পাধীন তিন জেলার জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দসমূহে ৩৬ লাখ টাকার বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : পদ্মা সেতু হয়ে যে রুট ধরে ইউরোপে যাবে ট্রেন
পদ্মা সেতুর ব্যয় প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়। নদীশাসন, মূল সেতু, পুনর্বাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ করতে হয়েছে। বিদ্যুৎ লাইন ও গ্যাস লাইনও আছে। আমাদের মূল সেতুর খরচ কিন্তু ১২ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে বিদ্যুৎ লাইন আছে সেখানেই প্রায় এক হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। গ্যাস লাইন আছে, সেখানেও ৩০০ কোটি টাকার উপরে চলে যাচ্ছে। শুধু ব্রিজে ১২ হাজার কোটি টাকা নেই। এটা অনেকে বুঝতে পারে না। এটা কিন্তু রেলসেতুসহ, মানে দুইটা সেতু। মেঘনা সেতু একটা, ভৈরব সেতু একটা। পদ্মা কিন্তু দুইটা সেতু। এটা ছয় লেনের সেতু। ট্রেন কিন্তু যাবে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে। এত হাইস্পিড ট্রেন যাবে। এটা ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের একটা অংশ। এই লোডটা সেতুর ওপর দিতে হয়েছে। এই সেতুর ১০০ বছরেও কিছু হবে না।
তিনি আরও বলেন, সেতুর খরচ কিন্তু ভুলভাবে দেখানো হচ্ছে। তুলনা করলে বাংলাদেশের অন্যান্য সেতু থেকে খরচ কম। মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতুতে কত খরচ করেছি। রেলওয়ে সেতুর খরচ কত? সব মিলিয়ে দেখলে খরচ বেশি হয়নি।
২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আরও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।