অক্টোবর থেকে দেশের সব স্কুল-কলেজে সশরীরে পাঠদান শুরু হতে পারে। করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। করোনা সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় পরামর্শক কমিটির সম্মতি পাওয়ায় দ্রুত এ বিষয়ে ঘোষণা দিতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামীকাল বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) উচ্চপর্যায়ে বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) ঘোষণা আসতে পারে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে।
করোনার কারণে বারবার বাড়ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। সেপ্টেম্বরের দিকে খুলে দেওয়ার আলাপ চলছিল। কিন্তু সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে না নামায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরেক দফা বাড়িয়ে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছুটি আরও ১৫ দিন বাড়তে পারে। ১৮ বছরের ওপরের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের যদি আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে টিকাদান সম্পন্ন হয়, তাহলে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে শিক্ষা সম্পর্কিত দুই মন্ত্রণালয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির মতামতের ওপর।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অলস সময় পার করছে। তাদের মধ্যে অনেকে খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিশোর গ্যাং বাড়ছে, টিকটক, মাদকাসক্তিতে ঝুঁকছে। এতে করে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। অনেক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে। সমাজে অপরাধ ও শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার বন্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে।
অক্টোবর মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন অনলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিং করবে মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে ১২ বছর পর্যন্ত বয়সের শিক্ষার্থীদের ফেসশিল্ড ব্যবহার করতে হবে।
প্রাথমিকে পঞ্চম ও চতুর্থ শ্রেণির সপ্তাহে ছয়দিন অন্য স্তরে সপ্তাহে একদিন ক্লাস নেওয়া হবে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই ধাপে ধাপে সশরীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর নির্দেশনা দিয়েছেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শতভাগ টিকা নিয়েছেন কিংবা টিকাদান সম্পন্ন হবে তারা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে পাঠদান শুরু করতে পারবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অক্টোবর মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন টিকার আওতায় এসেছেন, কতজন পাননি, কাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই সে তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দ্রুততার মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) নেই, স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের এনআইডি কার্ড তৈরির চেষ্টা করা হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে ভিন্ন পদ্ধতিতে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. ফেরদৌস জামান বলেন, পাবলিক-প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে গত সোমবার (৩০ আগস্ট) চিঠি দেওয়া হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে এ তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য একত্রিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বেশি দিন বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। আগে সিদ্ধান্ত ছিল করোনা সংক্রমণ ৫ শতাংশে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। এ বিষয়ে চলতি সপ্তাহে কমিটির সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। আগামী বুধবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আন্তঃমন্ত্রণালয়, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
ওই অতিরিক্ত সচিব বলেন, অক্টোবর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নতুন করে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদানের উপযোগী করে তুলতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুরুতে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সপ্তাহে ছয়দিন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস করানো হবে। একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের তিনটি ক্লাসে ভাগ করে ক্লাস নেওয়া হবে।
আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্তরের পঞ্চম ও চতুর্থ শ্রেণির সপ্তাহে ছয় দিন, অন্য স্তরে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস নেওয়া হবে।
বুধবার ফের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা
সংক্রমণের হার কত শতাংশ হলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে এবং ১২ বছরের নিচের শিক্ষার্থীদের মাস্ক না ফেসশিল্ড পরবে- এই দুটি বিষয় চূড়ান্ত করতে আগামী বুধবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা বসবে। পরদিন বৃহস্পতিবার সরকারের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।
জেলায় জেলায় টিকাকেন্দ্র
দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার লক্ষ্যে কেবল ১৮ বছরের ওপরের শিক্ষার্থীদের জন্য জেলায় জেলায় টিকাদান কেন্দ্র করা হবে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলাপ হয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে উপজেলা পর্যায়েও টিকাকেন্দ্র করা হবে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী মাসের মধ্যে শতভাগ শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ কারণে কেউ টিকা নিতে না পারলে তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবির বলেন, বর্তমানে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসছে। এটিকে বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। সংক্রমণ এড়াতে এক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তিনটি শ্রেণিকক্ষে ভাগ করে ক্লাস নিতে হবে। সেটি নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে একাধিক কমিটি গঠন করতে হবে। প্রতি কমিটিতে ৫-১০ জন করে অভিভাবক রাখা যেতে পারে। অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অলস সময় পার করছে। তাদের মধ্যে অনেকে খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিশোর গ্যাং বাড়ছে, টিকটক, মাদকাসক্তিতে ঝুঁকছে। এতে করে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। অনেক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে। সমাজে অপরাধ ও শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার বন্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে।