উপজেলা সদরে আলাদাভাবে পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আলাদা ভবন নির্মাণ করা হলে পাবলিক পরীক্ষার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে ক্লাস চালু রাখা যাবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব ভবন ব্যবহার করা যাবে।
একইসঙ্গে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে সব বিভাগীয় শহরে শিক্ষাবোর্ড নির্মাণ, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পুল গঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন করা এবং উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছেন জেলা প্রশাসকরা।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন তারা। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ শিক্ষা সংক্রান্ত তিন বিভাগের সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের হাতে এসব সুপারিশ তুলে দেওয়া হয়েছে।
পাবলিক পরীক্ষার জন্য আলাদা কেন্দ্র স্থাপন
সম্মেলন সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকা, খুলনা, নড়াইল ও নেয়াখালী জেলা প্রশাসকরা পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনে উপজেলা সদরে আলাদা ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাব করেছেন। তার কারণ বলা হয়েছে, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্র স্থাপন করায় সেসব প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ক্লাস বন্ধ থাকে। পরীক্ষার কারণে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হয়। আলাদাভাবে পরীক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত ক্লাস করতে পারবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ভবনটি ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
কারিগরি শিক্ষার প্রসার
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কারিগরি শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধির প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। দেশের মানুষকে দক্ষ ও জনশক্তিতে রূপান্তর করে গড়ে তোলার জন্য তিনি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কারিগরি বিভিন্ন কোর্স অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
বিভাগীয় শহরে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড
দেশের সব বিভাগীয় শহরে পূর্ণঙ্গ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জোলা প্রশাসক। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলমান। এত বিপুল সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য একাধিক কারিগরি শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশের বিশাল জনশক্তিকে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য একাধিক কারিগরি শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব জানান তিনি।
অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পুল গঠন
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগে পুল গঠনের প্রস্তাব জানিয়েছেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার। তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে একটি পুল তৈরি জরুরি। এতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধ করা সম্ভব হবে। যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে। পুলে জেলা প্রশাসককে সম্পৃক্ত করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চেঞ্জ রুম স্থাপন, স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণের প্রস্তাব রেখেছেন বাগেরহাট ও নাটোরের জেলা প্রশাসক। তারা প্রস্তাব করেন, শিক্ষার্থীদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এসব সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া গেলে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতার চক্র ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে। দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অপ্রতুল সুপেয় পানির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক স্বচ্ছতায় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে প্রস্তাব দিয়েছেন চাাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। খাতভিত্তিক ব্যাংক হিসাব খুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন ও ফি প্রদান/গ্রহণসহ সব লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে করা যাবে। সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব লেনদেন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ভূমি সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ
বর্তমানে দেশে শিক্ষা হার বৃদ্ধি পেলেও ভূমি সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা স্বল্প। ফলে একদিকে যেমন জনসাধারণ ভূমি সেবা সম্পর্কে হয়াকিবহাল থকে না, অন্যদিকে অসৎ প্রকৃতিক মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে জনদুর্ভোগ বেড়ে যায়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার।
উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি গঠন
উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কমিটির নামে একটি কমিটি রয়েছে, যা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি না থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সমন্বয় বা তদাররি করা যাচ্ছে না। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি না থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক।
টেক্সটাইল কলেজ স্থাপন
মৌলভীবার জেলা প্রবাসী আধ্যুষিত এলাকা। টেক্সটাইল কলেজ স্থাপন করা হলে এখানে এ শিল্পের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি হবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারবে। মৌলভীবাজার জেলায় উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং উদ্যোক্তা তৈরি হবে। টেক্সটাইল কলেজ স্থাপনের এ দাবি এলাকাবাসীর বলে উল্লেখ করেছেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
ঢাকা শহরে ছয়টি এবং সব বিভাগীয় শহরে একটি করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ঢাকা ও বরিশালের জেলা প্রশাসকরা। তাতে বলা হয়েছে, বিভাগীয় শহরে বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। বিভাগীয় শহরে অন্য জেলার শিক্ষার্থীরাও উন্নত শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আসে। সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে উন্নত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা যাবে। শিক্ষার জন্য মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
স্কুল ভর্তিতে বয়স সংশোধন
শিক্ষানীতি ও শিক্ষাবোর্ডের ভর্তি পরীক্ষা নীতিমালায় শিক্ষার্থীদের বয়স সংক্রান্ত সাংঘর্ষিক বিধান সংশোধন করে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক। তিনি জানান, শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে বয়স ৬+ বছর প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে এসএসসি পরীক্ষা দিতে বষয় ১৬+ বছর হতে হয়। কিন্ত শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা মোতাবেক ১৪+ বছর বয়স হলেই এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায়। স্কুল পরিবর্তন করে দেশের নামিদামি সরকারি-বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় বা তদূর্ধ্ব শ্রেণিতে ভর্তির সময় জন্মসনদ সংশোধন করে বয়স কমানের প্রবণতার অবসান হবে।
এছাড়াও ময়মনহিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে ময়মনসিংহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালনা কমিটিতে জেলা প্রশাসককে অন্তর্ভুক্তকরণ, রাজবাড়ী জেলায় মীর মশাররফ হোসেনের সমাধিস্থলের পাশে তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছেন জেলা প্রশাসকরা।
জেলা প্রশাসকদের এসব প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় কী অবস্থা, এখনো কী কী সমস্যা রয়েছে তা জেলা প্রশাসকদের নানা প্রস্তাবের মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমরা জেলা প্রশাসকদের নানা ধরনের প্রস্তাব পেয়েছি। তারা মাঠ পর্যায় থেকে নানা সমস্যা ও তার উত্তরণমূলক অনেক প্রস্তাব রেখেছেন। সেসবের যৌক্তিকতা বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি।