দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদাও। চলতি বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ যখন চূড়ায়, সে সময়ের চেয়ে এখন অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে ৪০ শতাংশ। সংকটাপন্ন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির ধারায় এ চাহিদা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা করছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে জোর চেষ্টার তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যদিও সংকট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে দাবি করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
দেশে ক্রমবর্ধমান অক্সিজেনের সংকট মেটাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এখন এগিয়ে আসছে। আবুল খায়ের গ্রুপ ও জিপিএইচ ইস্পাতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করেছে। তার পরও বর্তমানে যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় অক্সিজেন সরবরাহে বড় সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত এপ্রিলে দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ে নভেল করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ছিল ৫ শতাংশের কম। সে সময় দিনে সক্রিয় করোনা রোগী ছিল প্রায় ৯০ হাজার। সরকারি ও বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা ছিল ৬০০। সে সময় এসব হাসপাতালে ছিল সাড়ে ১৪ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার, এক হাজার হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ৯০০ এর কম অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশে বর্তমানে ১ লাখ ১৫ হাজার সক্রিয় রোগী রয়েছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। যাদের উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিতে হচ্ছে, তাদের সংখ্যাও কম নয়। বর্তমানে দেশের এসব হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ১ হাজার ২০০টি, ১ হাজার ৫৮৬টি রয়েছে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২৮ হাজার ৩৪৪টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ১ হাজার ৭২৭টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা বলছে, দেশে স্বাভাবিক সময়ে দিনে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের চাহিদা প্রায় ১০০ টন। তবে এপ্রিলের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় অক্সিজেনের চাহিদা প্রতিদিন ১৪০ থেকে ১৫০ টনে দাঁড়ায়। এপ্রিলের চেয়ে এখন সংক্রমণ শনাক্ত বেশি হচ্ছে। একই সঙ্গে হাসপাতালে সংকটাপন্ন করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২১০ টনে, যা এপ্রিলের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালটিতে ৪৩৪টি সাধারণ শয্যা নির্ধারিত রয়েছে। তবে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে অর্ধশতাধিক রোগী প্রতিদিনই এখানে ভর্তি থাকেন। হাসপাতালটিতে স্বাভাবিক সময় ৬০০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এ চাহিদা ১০ গুণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক ছয় থেকে আট হাজার লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। সংকট মোকাবেলায় আরো ১৫ হাজার লিটারের বেশি অক্সিজেন মজুদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়লেও সংকট নেই বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২১০ থেকে ২২০ টন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ৯০ টন উৎপাদন করলেও তারা ১২০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করে। উৎপাদনের বাইরে বাকিটা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে লিন্ডে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড ৫০ টন ও ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড ৪০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে। বর্তমানে সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়েই চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করতে চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে যে হারে চাহিদা বাড়ছে, তাতে শিগগিরই সংকট দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তারা জানান, সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করে অক্সিজেন উৎপাদন করছেন তারা। এ মুহূর্তে উৎপাদন সক্ষমতা আর বাড়ানো সম্ভব নয়।
ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সর্বোচ্চ সক্ষমতায় আমরা দিনে ৪০ টন উৎপাদন করতে পারি। এখন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করেছি। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে অক্সিজেনের চাহিদা বেশি আসছে। বিষয়টা এমন যে আমরা যত দিতে পারব তারা ততই নেবে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হলে অক্সিজেনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করছে লিন্ডে বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এর বাইরে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিলিন্ডারে অক্সিজেন এনে তাও সরবরাহ করছেন তারা। এছাড়া সংকট মোকাবেলায় আবুল খায়ের গ্রুপ ও জিপিএইচ ইস্পাত মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করলেও এসব প্রতিষ্ঠান দিনে সর্বোচ্চ ৫০ টন মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
সংক্রমণ যত বাড়বে, সংকট তত সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বর্তমানের তুলনায় রোগী শনাক্তের সংখ্যা বাড়লে হাসপাতালগুলোতেও চাপ বাড়বে। শনাক্তের সংখ্যা দৈনিক ১৩ হাজারের ওপরে উঠলে অক্সিজেনের তীব্র সংকট সৃষ্টি হবে। ফলে সংক্রমণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করে রাখতে হবে। এতে সংকটের সময় প্রয়োজন মেটানো যাবে।
সংকট মোকাবেলায় সরকারের আগাম প্রস্তুতি থাকা দরকার বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। বণিক বার্তাকে বলেন, অক্সিজেনের অভাবে করোনা রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অন্তত সব জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতালে অক্সিজেন প্লান্ট নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এটা কঠিন কিছু নয়। সংকট সৃষ্টি হলে বিদেশ থেকে সিলিন্ডার অক্সিজেন যেন আমদানি করা যায় সে বিষয়টি এখনই ভাবতে হবে।
তবে আসন্ন সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে বলে দাবি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও সংকট নেই। শিল্প অক্সিজেন বন্ধ করে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করা হবে। একই সঙ্গে ভারত থেকে বন্ধ হওয়া অক্সিজেনের আমদানি শুরু হয়েছে। সেখান থেকে আমরা দিনে ৩৫ থেকে ৪০ টন অক্সিজেন আমদানি করে থাকি। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য কাজ করছে। সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।