সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

UCB Bank

ঢাকায় রাতের আকাশে বিমান লক্ষ্য করে লেজার নিক্ষেপ, বিপদে পাইলটরা

প্রকাশঃ

ঢাকায় রাতের আকাশে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় এলোমেলো লেজার রশ্মির কবলে পড়েন পাইলটরা। ‘উড্ডয়নরত বিমানের দিকে লেজার নিক্ষেপ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে’—সম্প্রতি মোবাইল ফোনে এমন এসএমএস বার্তা পাঠানো হয় সরকারের তরফ থেকে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পাইলটরা বলছেন, বিমানবন্দরে অবতরণকারী উড়োজাহাজ লক্ষ্য করে ছোড়া লেজার লাইট যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বিমান ও যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে প্রায়ই কিছু মানুষ উড়োজাহাজে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করছে। পাইলটদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। দেশি-বিদেশি কয়েকটি বিমান সংস্থা এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বারবার অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে সৌদিয়া এয়ারলাইনস ও কাতার এয়ারওয়েজও রয়েছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড্ডয়নরত উড়োজাহাজের বেলায় লেজার রশ্মিকে বিশ্বে ‘আক্রমণাত্মক অস্ত্র’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ উড়োজাহাজ ওঠানামার সময় এই রশ্মি পাইলটের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

লেজার কী

‘লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন’, যার সংক্ষিপ্ত রূপ লেজার। এটি এক ধরনের আলোক রশ্মি। বিশেষ উদ্দীপনায় বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তৈরি করা হয় লেজার। চিকিৎসাক্ষেত্রে কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসা, ক্ষতস্থান নিরাময়, দাঁত কিংবা চোখের চিকিৎসায় লেজার রশ্মির ব্যবহার হয়ে থাকে।

কিন্তু এখন ঢাকায় রাতের বেলায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের হাতে হাতে দেখা যায় লেজার লাইট। এই লাইট ছুড়ে তারা যানবাহনকে সংকেত দেয়। পুলিশ বিভাগ এরই মধ্যে এই লাইট ব্যবহার আইনসম্মত নয় বলে স্বীকার করেছে। এর পরও পুলিশের অনেক সদস্য লেজার লাইট ব্যবহার করে চলছেন। তাঁদের ব্যবহার করা লেজার লাইটের রশ্মিও অসাবধানতাবশত পাইলটের চোখে গিয়ে পড়ছে।

এ ছাড়া বিমানবন্দরের আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকে মজা করে রাতের আকাশে উড়োজাহাজের দিকে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে। ঢাকায় বিমানবন্দর সড়ক, নিকুঞ্জ এলাকায় বাসাবাড়ির ছাদ থেকে লেজার রশ্মি ফেলার ঘটনা ঘটছে। পাশের কয়েকটি হোটেল থেকেও লেজার মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পাইলটরা বলছেন, ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সৈয়দপুরসহ কয়েকটি বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে বিমান অবতরণের সময় প্রায়ই লেজার লাইট মারা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি একটি এয়ারলাইনসের পাইলট বলেন, যারা মজার ছলে এই কাজ করছে, তারা হয়তো বুঝতেই পারছে না, এটি কতটা বিপজ্জনক। প্রতিটি বিমানবন্দরে অবতরণের সময় চার্ট ফলো করতে হয়। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে হয়। ওই সময় লেজার নিক্ষেপ করলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। আবার চার্ট ও ইনস্ট্রুমেন্ট দেখতে সমস্যা হয়।

জানতে চাইলে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন শামস বলেন, ‘আমরা ঢাকায় অবতরণের সময় উড়োজাহাজের ককপিটের দিকে উচ্চ ক্ষমতার সবুজ লেজার লাইটের আধিক্য দেখি। লেজার লাইট লাল, নীলসহ নানা রঙের হয়ে থাকে। তবে আমরা সবুজ লাইট নিয়ে বিপাকে আছি। এই রং চোখে লাগলে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এগুলো চোখের দৃষ্টি সাময়িকভাবে অকার্যকর করে ফেলে। ঢাকায় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা এলাকা থেকে এসব আলো বেশি আসে। ’

ক্যাপ্টেন শামস বলেন, আগে এতটা ছিল না। এখন অহরহ ঘটছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন এবং কঠিন পদক্ষেপ দরকার।

জানতে চাইলে বেসরকারি এয়ারলাইনস নভো এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘উড়োজাহাজ ওঠানামার সময় আশপাশের এলাকায় লেজার রশ্মি নিক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক। এ সময় পাইলটের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হলে বিমান দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা প্রতি মাসে এয়ারপোর্ট অপারেশনস সভায় বিষয়টি বলে যাচ্ছি। কিন্তু উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। ’

কর্তৃপক্ষ কী বলছে

বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছি। এসএমএস পাঠানো, টিভি স্ক্রল দেওয়া, মতবিনিময়সহ আমরা পুলিশকেও বিশেষভাবে এদিকে নজর রাখার অনুরোধ করেছি। যেসব এলাকায় আমাদের বিমানবন্দরগুলো আছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট থানাকেও আমরা পদক্ষেপ নিতে বলেছি। উড়োজাহাজে কেউ লেজার নিক্ষেপ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ’

বেবিচক সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড অপারেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী এম জিয়াউল কবীর বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট থানায় জানিয়ে দিই। এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেও কাজ করা হচ্ছে। ’

শাস্তি কী?

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ২০১৭ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা বেপরোয়াভাবে বিমান পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী এম জিয়াউল কবীর বলেন, ‘এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং যারা এভাবে লেজার মারছে, আশা করি তারা সতর্ক হবে। ’

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি শাহ আকতারুজ্জামান মো. ইলিয়াস বলেন, ‘উড়োজাহাজে লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু কাউকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা কঠিন। ’

শেয়ার করুনঃ

উপরের পোস্টটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এই মাত্র প্রকাশিত

এই বিভাগের আরও সংবাদ