সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার প্রতীক ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। ফুলের চাহিদা তাই ক্রমবর্ধমান। সারা বছরই বিয়ে, জন্মদিন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ নানান অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার বাড়ছে। ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখে দেশব্যাপী ব্যাপক আয়োজনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান যেন ফুল ছাড়া চলেই না। এসব উৎসবে ফুল হয়ে উঠেছে অন্যতম উপজীব্য। ফুলের এ চাহিদাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই বাড়ছে ফুলের বাজার।
ফুলের চাহিদা কম-বেশি সারাবছরই থাকে, তবে ফেব্রুয়ারি মাসে এ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কারণকেননা এ মাসেই রয়েছে পহেলা ফাল্গুন, বিশ্বভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো দিবস। এসব দিবসে কাউকে সন্তুষ্ট করতে বা মনের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ফুলের জুড়ি মেলা ভার।
এসবকে কেন্দ্র করেই বড় হচ্ছে ফুলের বাজার। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের ফুল বিক্রির টার্গেট ২০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালিতে ফুল বিক্রির টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। বাকি ফুল বিক্রি হবে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে।
ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে ফুল এখন বিরাট অর্থকরী ফসলে পরিনত হয়েছে। সময়ের চাহিদার আলোকে দেশের অর্থনীতিতেও ফুলের অবদান ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফুলের বাণিজ্যিক প্রসার খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের আগে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। জানা গেছে ১৯৮২-৮৩ অর্থবছর থেকে দেশে ফুল অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত করা হচ্ছে। এরপর থেকে বাড়ছে ফুলের বাণিজ্য। দেশের গন্ডি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ফুল। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
সারা পৃথিবীতে ফুলের বাজার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে সার্বিকভাবে ফুলের বাজার মূল্য প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। একসময় শুধু যশোরে ফুলের চাষ হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে ২০টি জেলায় কমবেশি ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় যশোর ও ঝিনাইদহ জেলায়। এ ছাড়াও রয়েছে- চুয়াডাঙ্গা, সাভার, গাজীপুর, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মেহেরপুর, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, মানিকগঞ্জ ও নাটোর।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অধিকাংশ ফুলই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্রি হয়। ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে রয়েছে পাইকারি ফুলের বাজার। খুচরা বিক্রেতারা এসব জায়গা থেকে ফুল কিনে শহরে ছড়িয়ে পড়েন। ফুলের ব্যাপক চাহিদা ও বিরাট সুযোগ থাকার পরেও ফুল বিক্রির জন্য ঢাকায় কোন কেন্দ্রীয় বাজার নেই। তবে আশার খবর হলো রাজধানীর গাবতলীতে প্রায় দেড় একর জমির ওপর দুইতলা ভবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে ফুল চাষীদের জন্য স্থায়ী বাজার তৈরি হচ্ছে। ভবনটি হবে সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
দেশে ফুল চাষের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত অঞ্চল যশোর। গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরাসহ ১১ প্রজাতির ফুল সারা বছর চাষ হয় এখানে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিবস ঘিরে ভাল ব্যবসা করলেও বছরের অন্যান্য সময় ফুল সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব ও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় চাষীদের। জানা গেছে, কৃষি উন্নয়ন অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ফুলের বাজারটি নির্মাণ করা হবে। সেখানে আধুনিক মোড়কীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হবে ফুলের বাজারজাত প্রক্রিয়ায়। এর ফলে শ্রমের ন্যায্যমূল্যও পাবেন চাষীরা।
বিশ্ব ফুলের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুল বাংলাদেশের রফতানির তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে। জানা যায়, ১৯৯১-৯২ অর্থবছর থেকে ফুল রফতানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র মতে, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের ১২ হাজার টাকা, ১৯৯৪-৯৫ সালে ১৬ হাজার টাকা ফুল রফতানি হলেও ২০০৫ সালে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ কোটিতে দাঁড়ায়। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এদেশ থেকে ফুল রফতানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশের কাঁচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালী, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রফতানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে আরও বড় আকারের রফতানি প্রবেশের সুযোগ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্যে। তবে উদ্যোক্তাদের অভিমত, কাঁচা ফুল রফতানি করে ৫০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।