আবহাওয়ার পরিবর্তনের মধ্যেও তীব্র আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু রোগ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এর পরের অবস্থানে আছে পর্যটননগরী কক্সবাজার। ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও চিকিৎসা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্টোবরে এসে ডেঙ্গুর এই বাড়বাড়ন্ত একটু অস্বাভাবিক। শীত নামলেই কমে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো সামর্থ্যের বাইরেও রোগী ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কোভিড হাসপাতালটিতে এখন ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন এক হাজার বা এর কাছাকাছি মানুষ এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের বড় একটি অংশ আবার শিশু। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক আসাদ শিকদার মারা গেছেন।।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী রাকিবের রাতে হঠাৎ জ্বর এলে পরিবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করা হলে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পরবর্তীসময়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করাতে চাইলে বেড পাওয়া নিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। হাসপাতালটিতে খালি নেই কোনো সিট। অনেক অপেক্ষার পর একটি সিটের ব্যবস্থা হলে ভর্তি করানো হয় তাকে।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাহেদ হোসেন জ্বর নিয়ে বৃহস্পতিবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার শয্যায় একই সঙ্গে আরও একজন ডেঙ্গুরোগীকেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একই চিত্র রাজধানীর অন্য হাসপাতালেও। ডেঙ্গুরোগীর ভয়াবহ চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ভর্তি আছেন ৭০ জন ডেঙ্গু রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ১৮ জন। এছাড়া এবছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন ৭৩৯ জন ডেঙ্গুরোগী। মারা গেছে ১০ জন শিশু।
ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার অক্টোবরে এসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে। অন্য বছর এসময় ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যেত। থেমে থেমে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শীত এলে এর প্রকোপ কমে যাবে। প্রতিদিন যত সংখ্যক রোগী হাসপাতালে আসছে তাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এটি সামাল দিতে আলাদা দুটি ডেঙ্গু সেল তৈরি করা হয়েছে। ডেঙ্গুরোগীদের আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেই।
‘এডিস মশাবাহিত এই রোগের চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে ১২ শয্যা বরাদ্দ ছিল। সেপ্টেম্বরে সেটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। এর বিপরীতে বর্তমানে ৬৫ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। তাদের অধিকাংশের অবস্থা জটিল। অক্টোবরের ১৯ দিনে দুইশর বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। জায়গা দিতে না পারায় অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, আগের তুলনায় এবার ডেঙ্গুরোগীদের ধরনে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে কারও কারও রক্তক্ষরণ দাঁত, নাক, মুখ দিয়ে হতো। এখন সেটি ফুসফুসের মধ্যে হচ্ছে। এটি হলে তাকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেকে আক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে হাসপাতালে আসায় অবস্থা জটিল হয়ে যায়। সে কারণে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখাতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অতিরিক্ত চাপড়। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালে এক হাজার ৮৭৮ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি ১৯৬ জন রোগী।
এছাড়া মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়। হাসপাতালটিতে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯২ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছে ৩০ জন ডেঙ্গুরোগী। বর্তমানে এ হাসপাতালে ১৫৩ জন চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর কোনোটিতেই শয্যা খালি নেই। কিন্তু আমরা রোগীদের ফেরত পাঠাতে পারি না। যেভাবেই হোক চিকিৎসা দিচ্ছি। আমরা চাই না ২০১৯ সালের মতো গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হোক। এজন্য হাসপাতালগুলোতে আলাদা ডেঙ্গু ইউনিট চালু করতে হবে। পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মশারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। রোগী যদি মশারি না নিয়ে আসে, তাহলে হাসপাতাল থেকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গুর ভয়াবহতা জানিয়ে বলেন, এখন প্রত্যেক জেলায় ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতালে তিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি। আমরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা না কমলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো কঠিন। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শিগগির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্প নেই। যেসব এলাকায় মশা বেশি সেসব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনকে অ্যাকটিভ হতে হবে। যেন মশা কমে আসে, আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করা হবে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩২ হাজার ৭১৬ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৯ হাজার ৪৬৬ জন রোগী। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১১৮ জন।