রডের দাম বেড়ে চলেছে লাগামহীনভাবে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডের (৬০ গ্রেডের ওপরে) দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এক মাস আগেও প্রতি টন রড ৭৪ থেকে ৭৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৯ হাজার টাকা। কাঁচামাল সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রডের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ও ক্রেতারা বলছেন, উৎপাদনকারীদের সিন্ডিকেটের কারণে লাগামহীন রডের বাজার।
রডের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে স্থবির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন কাজ।
বিশ্ববাজারে কাঁচামাল সংকট বলছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির স্ক্র্যাপ (পুরনো লোহার টুকরো) ও পুরনো জাহাজের দাম বেড়ে গেছে। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা আছে ৩০টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানা আছে ১০০টির মতো। বছরে দেশে রডের চাহিদা আছে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। এই হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়। রড তৈরির কাঁচামাল হলো পুরনো লোহার টুকরো। এই কাঁচামাল সরাসরি আমদানি করে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেন উৎপাদকরা। বাকি প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ আসে জাহাজভাঙা শিল্প এবং লোকাল ভাঙারি বর্জ্য থেকে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় রডের দামও বেড়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল কেনা পড়েছে টনপ্রতি ৭৩ হাজার টাকা। এগুলো প্রসেসিং করে রড তৈরি করতে আরও ১৫ হাজার টাকা খরচ হবে। এতে টনপ্রতি রডে বর্তমানে উৎপাদন খরচ পড়ছে ৮৮ হাজার টাকা।’
তিনি বলেন, ‘একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারেও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। একসময় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে স্ক্র্যাপ কেনা হতো প্রতি টন ৩০০ ডলারে। এখন কেনা হচ্ছে ৬৪০ ডলারে। এর আগে বেশ কিছু দিন ৬০০ ডলার ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অনেক দেশ; যারা আগে দুই দেশ থেকে রড তৈরির স্ক্র্যাপ কিনতো, তারা এখন মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া থেকে কিনছে। আমরা আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে স্ক্র্যাপ কিনেছি। এখন আরও বেশি দেশ এসব দেশ থেকে কেনার কারণে প্রতি টন স্ক্র্যাপে ৪০-৫০ ডলার করে দাম বেড়ে গেছে।’
পুরনো জাহাজের দাম বেড়েছে
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআর) সহ-সভাপতি এসএম আল মামুন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পুরনো জাহাজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে টনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ ডলারে পুরনো জাহাজ কেনা হতো, বর্তমানে তা বেড়ে সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ ডলার ছুঁয়েছে। তার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স, কাটিংকস্টসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রডের দাম কিছুটা বেড়েছিল। এরই মধ্যে বিভিন্ন জাহাজের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে স্ক্র্যাপের দাম। বুধবার টনপ্রতি স্ক্র্যাপ বিক্রি হয় ৬১ হাজার টাকা।’
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে যা বলছেন উৎপাদনকারীরা
দেশে রড উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এরমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্ক্র্যাপের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুই দিন আগে যে স্ক্র্যাপের টন ৬৬০ ডলার ছিল, বৃহস্পতিবার তা ৭৪০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। দুই দিনের ব্যবধানে স্ক্র্যাপের দাম টনপ্রতি বেড়েছে ৮০ ডলার। বর্তমানে কেএসআরএম’র প্রতি টন রড বিক্রি করা হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৬ হাজার টাকায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প তথা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে আগে যে পরিমাণ স্ক্র্যাপ পাওয়া যেতো তা অনেক কমে গেছে। অধিকাংশ ইয়ার্ডে জাহাজ নেই। শিপ ইয়ার্ডের প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। ইউক্রেন থেকে স্ক্র্যাপের পাশাপাশি প্লেট আমদানি করা হতো। দেশটি আমাদের জন্য স্ক্র্যাপ আমদানির বড় বাজার ছিল। যুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে কোনও স্ক্র্যাপ আমদানি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অন্য দেশ থেকে স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হচ্ছে। গত ১৫ দিন ধরে আন্তর্জাতিকভাবে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। মূলত এসব কারণে রডের দাম বেড়েছে।’
১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে রড বিক্রি
উৎপাদনকারীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে দেশের বাজারে রডের টন সর্বোচ্চ ৮১ হাজার টাকায় উঠেছিল, যা তখন ইতিহাসের রেকর্ড দাম ছিল। তার আগে ওয়ান-ইলেভেনের (২০০৭-০৮) সরকারের সময় প্রতি টন রডের দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। চলতি বছরের শুরুতে রডের দাম কিছুটা কমে টনপ্রতি ৭৬ হাজার টাকায় নেমে আসে। তবে জানুয়ারির শেষ দিকে এসে আবারও বাড়তে থাকে। মার্চে এসে গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৯ হাজার টাকায় উঠলো রডের টন।
বিপাকে বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘রডের দাম অতিমাত্রায় বেড়েছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। রডসহ প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু যে আবাসন খাতে এই সমস্যা হচ্ছে তা নয়; সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বাড়ি নির্মাণ করতে পারছেন না। রডের বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছি। এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাই।’
সিদরাত সাইফ ডেভেলপার অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির চেয়ারম্যান এস এম শহিদুল্লাহ বলেন, ‘গত এক মাসের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা। গত মাসে যেখানে ৭৪ থেকে ৭৫ হাজার টাকা প্রতি টন রড কিনেছি, বর্তমানে ৮৮ থেকে ৮৯ হাজার টাকা কিনতে হচ্ছে। রডের বাজার অস্থির থাকায় নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজারের রড-সিমেন্ট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘আল মদিনা ট্রেডার্সের মালিক জিএম মোস্তফা বলেন, ‘গত এক মাসের ব্যবধানে রডের দাম টনপ্রতি ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বুধবার বিএসআরএম স্টিলের রড কিনতে হয়েছে ৮৯ হাজার ৫০০ টাকায়, বায়েজিদ স্টিলের রড ৮৭ হাজার টাকা, কেএসআরএমের ৮৮ হাজার টাকা এবং একেএস স্টিলের রড কিনতে হয়েছে ৮৮ হাজার টাকায়।’
তিনি বলেন, অথচ গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিএসআরএম স্টিলের রডের টন কিনেছি ৭৮ হাজার, বায়েজিদ স্টিলের ৭৬ হাজার, কেএসআরএমের ৭৭ হাজার এবং একেএস রড কিনেছি ৭৫ হাজার ৫০০ টাকায়। রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে নানা অজুহাতে রডের দামে বাড়িয়েছে। এজন্য সরকারের তদারকি বাড়ানো দরকার।’
জিএম মোস্তফা আরও বলেন, ‘রডের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি সিমেন্টের দামও বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বর্তমানে রুবি সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ টাকা, রয়েল সিমেন্ট ৪৭০ টাকা, কনফিডেন্স সিমেন্ট ৪৭৫ টাকা। অথচ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রুবি সিমেন্ট কিনেছি ৪২০ টাকা, কনফিডেন্স সিমেন্ট ছিল ৩৯০ টাকা ও রয়েল সিমেন্ট ছিল ৩৯৫ টাকা।’
চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মহিউদ্দীন সেফুল বলেন, ‘রডের দামসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের অনেক উন্নয়নকাজ চালু রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামে বর্তমানে ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলমান আছে। এই মৌসুমে পুরোদমে উন্নয়নকাজ চলার কথা থাকলেও কাজের গতি কমে গেছে। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা যাবে না প্রকল্প। রড, সিমেন্ট, ইটসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে তদারকি বাড়ানোর আহ্বান জানাই।’