শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

UCB Bank

সাকিব যুক্ত হওয়ায় পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার জোরালো ইঙ্গিত

প্রকাশঃ

সাকিব আল হাসান যুক্ত হয়ে ভাগ্য ঘুরিয়ে দিলেন প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকটির। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নমনীয় বলে জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে। সাকিব ও তার মা পিপলস ব্যাংকের শেয়ার ধারণের জন্য যে অর্থ ইতিমধ্যে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন হিসেবে জমা দিয়েছেন, সেই অর্থ দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনে আয় করা এমন নিশ্চয়তা মিললে এবং পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে এই দুজনার কোনো আইনগত সীমাবদ্ধতা না থাকলে পিপলস ব্যাংককে লাইসেন্স দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পিপলস ব্যাংকের ভাগ্য আটকে ছিল সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালকরা মূলধন জোগান দিতে না পারার কারণে।

প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া এ ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের দরকার ছিল ৪৮৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্য পরিচালকের মূলধন হিসেবে দেখানো হয়েছিল। যা নিয়ে আপত্তি ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিকে ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স দিচ্ছিল না বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্প্রতি ব্যাংকটির শেয়ারের বড় একটি অংশ জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তার মায়ের কাছে বিক্রি করায় প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক আবারও আলোচনায় উঠে আসে। গত সপ্তাহে সাকিব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে দেখা করে ব্যাংকটির লাইসেন্সের বিষয়টি নিয়ে তদবির করেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘এর আগেও ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের মূলধনের টাকা নিয়ে আমরা খোঁজ নিয়েছি। তখন দেখেছি তাদের মূলধনের টাকা অন্যদের কাছ থেকে আনা। ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে হলে বৈধপথে আয় করা টাকা থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র থাকতে হবে। আয়কর নথিতে ওই টাকা উল্লেখ আছে কি না আমরা তাও দেখি।’

সাকিব ও তার মা শিরিন আক্তারের দেওয়া মূলধনের টাকা বৈধপথে আয় করা হলে এবং এই টাকার বিপরীতে সঠিকভাবে কর দেওয়া থাকলে তাদের পরিচালক হওয়ার বিষয়ে কোনো বাধা থাকবে না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এই টাকার খোঁজ নিচ্ছি। মূলধনের এই টাকায় কোনো অসংগতি না থাকলে পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্স প্রাপ্তিতে কোনো অসুবিধা দেখি না। তবে তাদের কোনো ব্যাংকে খেলাপি থাকা যাবে না।’

এদিকে ৩১ ডিসেম্বর প্রস্তাবিত এই ব্যাংকটির লেটার অব ইন্টেন্ড (এলওআই)-এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর প্রস্তাবিত ব্যাংকটিকে আবারও এলওআইর জন্য আবেদন করতে হবে কি না জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, ‘এটা কোনো সমস্যা নয়। তাদের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হবে। এর আগে সীমান্ত ব্যাংকের লাইসেন্সের সময়ও এভাবে সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেরিতে হলেও যদি ব্যাংকটি মূলধন জোগাড় করতে পারে তাহলে তারা লাইসেন্স পাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ব্যাংক পিপলস ব্যাংককে এলওআই দেয়। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারলে তাদের ব্যাংকিং ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংকটির মালিকরা ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করার আগে ৪৮৫ কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করবে। এরপর লাইসেন্স পাওয়ার প্রায় তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে।

পিপলস ব্যাংককে দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এলওআইর ৩১ নম্বর শর্তে বলা হয়েছিল, এলওআই ইস্যুর ছয় মাসের মধ্যে সকল শর্ত পূরণ করে লাইসেন্স গ্রহণের আবেদন না করলে এলওআই বাতিল হবে। যদিও এর ৩ নম্বর শর্ত গত প্রায় তিন বছরেও পূরণ করতে পারেননি ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তা আবুল কাশেম। ৩ নম্বর শর্তে বলা আছে, ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যানের বাংলাদেশি নেটওয়ার্কের ৫৬ লাখ টাকা বাদে অবশিষ্ট প্রয়োজনীয় অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে তার নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রদর্শিত সম্পদ থেকে অর্জিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনতে হবে।

এসব শর্ত পূরণ করতে না পারায় প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংককে তিনবার সময় বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় বাড়িয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময় শেষ হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর। ওই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক লিখেছিল, এরপর শর্ত পূরণ না হলে এলওআই চূড়ান্তভাবে বাতিল হবে। এখন সাকিব ও তার মা পরিচালক হওয়ার শর্ত পূরণ করতে পারলে এলওআইর মেয়াদ আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির পরিচালনা পর্ষদের সভায় বেঙ্গল কমার্শিয়াল, সিটিজেন ও পিপলস নামে তিনটি ব্যাংককে প্রাথমিক সম্মতিপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক চলতি বছরের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। আর চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সিটিজেন ব্যাংক।

প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম গত সপ্তাহে টেলিফোনে বলেন, ‘সাকিব আল হাসান ও তার মা আমাদের ব্যাংকের শেয়ার কিনছেন। এটি সত্য। তারা আমাদের ব্যাংকের পরিচালক হতে যাচ্ছেন।’

এতদিন লাইসেন্স না পাওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনে পাওয়া অনিয়ম সম্পর্কে আবুল কাশেম বলেন, ‘ননসেন্স রিপোর্ট। ভুয়া কথা। আমরা কোনো অনিয়ম করিনি।’

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, একটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শহীদুল আহসান তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এজি অ্যাগ্রোর নামে অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেন। ওই পরিমাণ টাকা শহীদুল আহসান তার মেয়ে রাহনুমা আহসানকে পরিচালক করার জন্য প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে দিয়েছেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী শুধু কর পরিশোধিত আয়করকে মূলধন হিসেবে দেখানো হয়। ঋণের টাকায় রাহনুমা আহসানকে পরিচালক করার তথ্যটি বিএফআইইউ তদন্তে ধরা পড়ে।

পিপলস ব্যাংকঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র ও নথিপত্র বলছে, প্রস্তাবিত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের ৪৪৮ ম্যাগডোনাল অ্যাভিনিউয়ের (তৃতীয় তলা) রফিক অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস, সিপিএ, এলএলসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিজের সম্পদের বিবরণ নেন। সেই বিবরণ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ এমবাসির কাছে পাঠানো হলে, ওই বছরের ২ নভেম্বর দূতাবাসের কাউন্সিলর শামসুল আলম চৌধুরী সম্পদের বিবরণীতে স্বাক্ষর করে সত্যায়িত করে দেন।

সেখানে বলা হয়, আবুল কাশেমের নগদ অর্থ ব্যাংকে আছে ৬২ হাজার ১৫০ ডলার। নগদ টাকার বাইরে তার স্বর্ণালঙ্কার ও সংগ্রহ (কী ধরনের সংগ্রহ তা বলা হয়নি) ২০ হাজার ৮০০ ডলার। ঘরের ফার্নিচার ও টিভি-ফ্রিজ, ব্লেন্ডারসহ হোম অ্যাপ্লায়েনস ২২ হাজার ৩৬০ ডলার, ব্যক্তিগত গাড়ির মূল্য ১৯ হাজার ৩৫১ ডলার, কাশেম কন্টাকটিং নামের রেন্ট-এ-গাড়ির বিজনেসের মূল্য ধরেছেন ১৮ হাজার ৩৩ ডলার, কিংস্টোন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মূল্য ধরেছেন ২৪ লাখ ৯০ হাজার ও তার বাড়ির মূল্য ধরেছেন ২১ লাখ ৬২ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে তিনি নগদ ও অন্যান্য অর্থ মিলিয়ে সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ৫১ লাখ ৪৯ হাজার ১৬ ডলার।

ব্রুকলিনে বসবাসকারী তিনজন প্রবীণ বাংলাদেশি দেশ রূপান্তরকে টেলিফোনে জানিয়েছেন, এসব তথ্য সন্দেহজনক। তিনি একসময় কিছু বাড়ি কিনে বিক্রি করেছেন। তবে বহুদিন সেই ব্যবসা বন্ধ।

আবুল কাশেমের ওই একই বিবরণীতে সম্পদের বিপরীতে কী ধরনের দেনা আছেন সে তথ্যও দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, আবুল কাশেমের বছরে বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি ও নিজের খরচ ১২ হাজার ৩৯০ ডলার, ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বছরে ব্যয় ৪ হাজার ২৮১ ডলার, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের সুদ দিতে হয় ১০ হাজার ৩৪৫ ডলার। সব মিলিয়ে বছরে তার খরচ হয় ২৭ হাজার ১৬ ডলার।

যেভাবে ব্যাংকের প্রাথমিক সম্মতি পেলেন : আবুল কাশেমের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে আশির দশকের শেষ দিক থেকে বসবাস শুরু করেন। গাড়ি মেরামত ও পুরনো বাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা করতেন। তবে এখন আর বাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা বহুদিন ধরে নেই। লাইসেন্স ফি নবায়ন করতে না পেরে সেটা বন্ধ আছে। নিজেকে তিনি পরিচয় দেন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে।

প্রবাসীরা বলেন, ব্যাংকের মালিক হতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন আবুল কাশেমের কাছে টাকা দিয়ে ফেঁসে গেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আলিম, খান ব্রাদার্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল কবির খান, তমা কনস্ট্রাশনের পরিচালক মুকিতুর রহমান, কার সিলেকশনের কর্ণধার আসলাম সেরনিয়াবাত এবং জাকির হোসেন পাটোয়ারী, সামিহা আজিম, তাসলিমা ইসলামসহ বাংলাদেশি ও প্রবাসী বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।

বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে আবুল কাশেমের পরিচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনের বাঙালিরা জানিয়েছেন, ওই মন্ত্রীকে তিনি গাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। প্রবাসীদের ধারণা, ওই সম্পর্কের সূত্রে আবুল কাশেম একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন বাগিয়ে নেন।

প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক সাকিব আল হাসান ও তার মা শিরিন আক্তারকে পরিচালক করার জন্য নথিপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে। সাকিব ও তার মায়ের বিনিয়োগ করতে হবে ২০ কোটি টাকা। তবে ২৫ কোটি টাকার মতো মূলধন দিচ্ছেন সাকিব।

প্রসঙ্গত, সাকিব আল হাসান ব্যাংক ছাড়া দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে সাকিবের শুরু হয় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা দিয়ে। বর্তমানে স্বর্ণ আমদানি ও বিপণন, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে তার।

শেয়ার করুনঃ

উপরের পোস্টটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এই মাত্র প্রকাশিত

এই বিভাগের আরও সংবাদ